গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলা হয়। চারটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার মোট আসামি ১৫০ জন।
রংপুরের পীরগঞ্জের বড় করিমপুর গ্রামে দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে যাওয়া জেলেপাড়ায় নতুন আধা পাকা ঘর উঠেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৩৯টি পরিবারের জন্য ঘর করে দিয়েছে সরকার। তাদের নিরাপত্তায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পটি এখনো আছে। ঘটনার ৯ মাস পর সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাঁরা পাকা ঘর পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের মনের ক্ষত রয়ে গেছে এখনো। এদিকে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় করা চারটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ চারটি মামলারই বিভিন্ন সময়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলার মোট আসামি ১৫০ জন।
এর মধ্যে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ মামলার আসামি ১৪৬ জন, বাকি ৪ জন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩টি মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই জামিনে থাকলেও কেউ কেউ এখনো কারাগারে রয়েছেন বলে স্থানীয় জনগণ ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
সেদিনের সহিংস ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। চারটি মামলারই অভিযোগপত্র বিভিন্ন সময়ে আদালতে দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পীরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবার রহমান।আবদুল আউয়াল, পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)
গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৯টি পরিবারের জন্য দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি করে পাকা ঘর ও শৌচাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সহিংস ঘটনার পরপরই সরকারি উদ্যোগে রংপুর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। পুড়ে যাওয়া দোকানঘরও পাকা করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ভ্যানও কিনে দেওয়া হয়েছে।
রাধা রানী ও পুষ্প রানীর বাড়িতে পুড়ে যাওয়া বিধ্বস্ত বাড়িঘরের এখন আর কোনো চিহ্ন নেই। আধা পাকা বাড়ির টিনের চালে রোদ পড়ে চিকচিক করছে। পাকা টিনের ঘর হলেও তাঁদের মনের ক্ষত এখনো রয়ে গেছে।
নতুন ঘরে রাধা রানী ও ক্ষুধারাম দাসের সংসার ভালোই কাটছে। ক্ষুধারামের মাছ ধরার পেশা এখনো আছে। খাল-বিল, নদীতে মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চলে যাচ্ছে তাঁদের। তিন মেয়ে ও এক ছেলের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে তাঁদের সঙ্গেই থাকেন।
রাধা রানী বলেন, ‘রাতে ঘুমালে প্রায় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। বাড়িতে আগুনের শিখা জ্বলছে। ভয়ে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।’
নিখিল দাসের স্ত্রী কনিকা রানীর মুদিদোকানটি পুড়ে যাওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে এখন সেখানে পাকা দোকানঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। দোকানে বসেই কনিকা রানী বলেন, ‘ভালো আছি। তবে সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে হলে এখনো ভয় হয়।’
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নতুন জীবন ফিরে পেলেও তাদের মধ্যে এখনো রয়েছে ভয়ভীতি ও শঙ্কা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘বাইরে বের হয়ে চলাফেরা করার সময় অপিরিচিতরা টিটকারি করে, ভয় লাগে।’
জেলেপাড়ার মাঝামাঝি স্থানে গাছের নিচে তিন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় দেখা গেল। তাঁরা তিনজন পর্যায়ক্রমে দিন–রাতে গ্রামের খোঁজখবর রাখেন। তাঁদের মধ্যে কথা হলো পীরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক মোস্তাক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে কোনো সমস্যা নেই। কারও কোনো অভিযোগ নেই। শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রয়েছে পুরো গ্রামে।
পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, সেদিনের সহিংস ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। চারটি মামলারই অভিযোগপত্র বিভিন্ন সময়ে আদালতে দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পীরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবার রহমান।
ওসি আবদুল আউয়াল আরও বলেন, ওই দিনের সহিংস ঘটনায় বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ লুটপাট মামলার আসামি ১৪৬ জন। বাকি তিনটি মামলা হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই তিন মামলার আসামি চারজন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাতে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুরের জেলেপাড়ায় দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ওই ঘটনায় পীরগঞ্জ থানায় চারটি মামলা করে পুলিশ।