ছোট ভাই কলেজছাত্র নজরুল ইসলাম চৌধুরী খুনের মামলার বাদী হয়েছিলেন বড় ভাই সামশুল ইসলাম চৌধুরী। দুই দশক, অর্থাৎ ২০ বছর আগে বাদী সামশুল মারা যান। ১০ বছর আগে মারা যান মামলার ৫ আসামির একজন। এ ছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৪ জন সাক্ষ্য না দিয়েই মারা যান। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়ার কলেজছাত্র নজরুলকে গুলি করে খুন করা হয় ৩৭ বছর আগে ১৯৮৭ সালের ৬ জানুয়ারি। পরদিনই এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন নিহত ব্যক্তির বড় ভাই। বর্তমানে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামে মামলাটির বিচার চলছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। এরপর গত ১১ বছরে ৬৬টি ধার্য দিনে শুধু তারিখ পড়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হওয়ায় বাদী, আসামি ও সাক্ষীরা মারা গেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যথাসময়ে সাক্ষ্য গ্রহণ হলে অপরাধ প্রমাণ করা সহজ হতো। আর মামলা নিষ্পত্তিতে ৩৭ বছর লাগত না।
আদালত সূত্র জানায়, ১৯৮৭ সালের ৬ জানুয়ারি লোহাগাড়ার পদুয়া হাইস্কুল মাঠে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে কলেজছাত্র নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে গুলি করে খুন করা হয়। ঘটনার সময়ে তিনি সাতকানিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। খুনের ঘটনায় তার বড় ভাই সামশুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে লোহাগাড়া থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, পদুয়া হাইস্কুল মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে আসেন তাঁর ভাই। ওই সময় খেলায় একটি দলকে সমর্থন করা নিয়ে তাঁর ভাইকে আসামিরা গুলি করে হত্যা করে। তদন্ত শেষে পুলিশ একই বছরের ২০ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এতে নওশের আলম, আবু নাছের, আবু জাফর, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল আজিজ নামের পাঁচজনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে আবু জাফর ২০১৩ সালে মারা যান। অন্য চারজন বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিল আসামিদের মধ্যে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। এর পর থেকে মামলার ১২ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৬ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় এনামুল হক নামের স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য হয়। এর পর থেকে গত ১১ বছর ধরে শুধু তারিখ পড়েছে। নথিতে দেখা যায়, এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬২টি তারিখ পড়েছে সাক্ষীর জন্য।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাতকানিয়া সার্কেলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) চন্দ্র কুমার চাকমাকে হাজির করতে একাধিক ধার্য দিনে প্রথমে সমন দেওয়া হয়। পরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। কিন্তু তিনি মারা যান ২০০৪ সালের ২১ এপ্রিল। কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন পুলিশের পক্ষ থেকে সেই প্রতিবেদন আসে গত জানুয়ারি মাসে।
একইভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক হায়াত ভুঁইয়া মারা যাওয়ার প্রতিবেদন আসে অনেক পরে। তিনি নিহত কলেজছাত্রের ময়নাতদন্ত করেছিলেন। এই মামলার দুজনই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।
মামলাটি জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আসে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ। এর আগে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। ওই সময়ে মামলাটির রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন অজয় বোস। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগের ঘটনা। কিছু মনে করতে পারছি না। তবে সাক্ষীরা না এলে মামলা নিষ্পত্তি কীভাবে হবে। আর সাক্ষীরা কে কোথায় আছে, বিশেষ করে পুলিশ কর্মকর্তারা—সেটি পুলিশকেই জানাতে হবে আদালতকে।’
সাত বছর আগে মামলাটি জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে আসে চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে। গত সাত বছরে ট্রাইব্যুনালে মামলাটির একজনেরও সাক্ষ্য হয়নি। জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সাক্ষী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের হাজির করতে বারবার সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। কিন্তু তাঁরা মারা গেছেন সেই প্রতিবেদন আসে অনেক পরে। এখন যেহেতু তাঁরা মারা গেছেন সাক্ষ্য সমাপ্ত করে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা থাকবে।
ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি বাবা। নিহত নজরুলের বাবা আছাদ উল্লাহ চৌধুরীও ছেলে খুনের ১০ বছর পর মারা যান। দীর্ঘদিন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখন আর মামলার খোঁজ নেন না নিহত ব্যক্তি পরিবার। জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের বেঞ্চ সহকারী সেকান্দর আলী প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির খোঁজ নিতে অনেক বছর ধরে বাদীপক্ষের কেউ কখনো আসেননি।
বিষয়টি স্বীকার করেন নিহত কলেজছাত্র নজরুল ইসলাম চৌধুরীর বড় ভাই দিদারুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৬ বছরেও কিছুই হয়নি। বাবা মারা গেছেন। আমি নিজেও অসুস্থ। শুরুতে মামলার খোঁজ নিতাম। বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মারা গেছেন। এখন খোঁজ নিতে হবে। মামলা যেভাবে চলছে, বাদী হয়ে বিচার দেখে যেতে পারি কি না সন্দেহ।’