মাগুরার মহম্মদপুরে প্রতিপক্ষের হামলার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ছাত্রদল নেতা আবু তৈয়ব মোল্যার (২৫) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার রাড়িখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে পাশের একটি কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। দুপুর ১২টার দিকে আবু তৈয়ব মোল্যার হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাড়িখালী বাজারে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী ও স্বজনেরা।
আবু তৈয়ব মোল্যা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের নাওভাঙা সলিমের চর গ্রামের মো. আবুল কালাম আজাদ মোল্যার ছেলে। তিনি ওই ইউনিয়ন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। ২১ আগস্ট ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গ্রামের আরব আলী নামের এক ব্যক্তির বাড়ির সামনে হামলার শিকার হন তৈয়ব। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। গতকাল বুধবার সকাল ১০টার দিকে ওই হাসপাতালে মারা যান তিনি।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পরস্পরকে দায়ী করেছে। হামলার পরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দায়ী করে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের এই অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে জেলা আওয়ামী লীগ। ওই সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় দুই সংসদ সদস্যসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেন, বিএনপির দুটি পক্ষের বিরোধে খুন হয়েছেন ওই যুবক।
সরেজমিনে আজ নিহতের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২১ আগস্ট বিকেলে ছাত্রদল নেতা আবু তৈয়ব মোল্যার ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করেন একই গ্রামের জিবলু বিশ্বাস (কৃষক দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত), ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রাজা মিয়াসহ কয়েকজন। ওই ছবিতে দেখা যায়, ওই ছাত্রদল নেতা গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। সেখানে আবু তৈয়ব মোল্যার ছাত্রদলের পদ নিয়েও কটাক্ষ করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ওই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে বিপরীত পক্ষের মাতবর জাহাঙ্গীর বিশ্বাসের কাছে যান তৈয়ব। সেখানে ওই পোস্ট মুছে দেওয়ার জন্য বলেন ছাত্রদলের ওই নেতা। তবে কোনো মীমাংসা না হওয়ায় তাঁরা ফিরে আসার জন্য হাঁটা শুরু করেন। এ সময়ই আরব আলী নামের এক ব্যক্তির বাড়ির সামনে তৈয়বের ওপর হামলা হয়।
এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় নিহতের ছোট ভাই তামিম হোসেন (১৬)। তামিম প্রথম আলোকে বলে, ‘তখন এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। সম্ভবত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হচ্ছিল। আমিও মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হই। ওরা পরিকল্পিতভাবে খুন করার জন্যই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। না হলে ভাইয়ের শুধু মাথায় কেন কোপাবে?’
হামলার পরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দায়ী করে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের এই অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে জেলা আওয়ামী লীগ।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার দিন তৈয়ব যখন মাতবর জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে রাড়িখালী গ্রামের রুবেল, সাজ্জাদ ও হান্নান নামের তিন যুবক ছিলেন। তৈয়বের ওপর হামলার সময় এই তিন যুবককে দড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও পুলিশ এসে তাঁদের উদ্ধার করেন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন প্রায় সাড়ে ৯টা বাজে। একজন মোটরসাইকেলে আহত তৈয়বকে বাজারে নিয়ে আসে। জানতে পারলাম, ঘটনাস্থলে কয়েকজনকে আটকে রাখা হয়েছে। গিয়ে দেখি রুবেল, সাজ্জাদ ও হান্নান নামের ওই তিন যুবককে আটকে রাখা হয়েছে। তখন মাতবর জাহাঙ্গীর বিশ্বাস, জিবলু বিশ্বাস, আওয়াল বিশ্বাসসহ কয়েকজন বলছিল, ওই যুবকদের নাকি ডাকাতি মামলায় দেবে। এমনকি নিজেদের একটি ঘরে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা (জাহাঙ্গীর)। যেন ওই যুবকদের দায়ী করা যায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় ওই যুবকেরা ছাড়া পায়।’
স্থানীয় লোকজন জানান, নাওভাঙা গ্রামের বাসিন্দারা দুটি গ্রাম্য দলে বিভক্ত, যার একটি অংশে রয়েছে ছাত্রদল নেতা তৈয়ব মোল্যার পরিবারের সদস্যরা। অন্য পক্ষের নেতৃত্ব দেন মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। দুটি দলেই আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী রয়েছেন। জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতা আবার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য মাতবর আবদুস সালাম সরদার। তাঁর সঙ্গেও নিহত ছাত্রদল নেতার পরিবারের দীর্ঘদিনের বিরোধ চলে আসছে।
তৈয়ব মোল্যার চাচা গোলাম রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সালাম সরদার এমন পরিকল্পনা করে আসছিল। এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ঘটনার এক দিন আগে সে তার বাড়িতে লোকজন নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছে। প্রায় ২০ দিন আগে বাজারে আমাকে ঘিরে ধরে মারতে গিয়েছে। অনেক আগে থেকে চেষ্টা করে এবার সে সফল হয়েছে।’
এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুস সালাম সরদার। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাড়িখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তৈয়ব মোল্যার বাবা মো. আবুল কালাম আজাদ। এমপিও জালিয়াতিসহ বেশ কিছু অভিযোগে তাঁকে ১১ মাস আগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ কারণেই আমাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। মূলত স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধেই এ ঘটনা ঘটেছে।’
মহম্মদপুর থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে একটি মামলা করেছিলেন নিহত যুবকের বাবা মো. আবুল কালাম আজাদ। এখন ওই মামলা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হবে। সেখানে নাওভাঙা গ্রামের জিবলু বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর বিশ্বাস ও পার্শ্ববর্তী রাড়িখালী গ্রামের আবদুস সালাম সরদারসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে আহাদ আলী ও জাহিদুল মোল্যা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা এখন কারাগারে।
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহম্মদপুর থানার পরিদর্শক মুন্সী রাসেল হোসেন আজ দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আগের মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে। প্রাথমিকভাবে এলাকাবাসীর কাছে জানা গেছে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করেই এ ঘটনা ঘটেছে।