‘এ্যাহন মানুষ আর ভোট দিতি আসতি চায় না। ভোট দি কী লাভ? আমি এমনিই আইছি ভোট দিতি।’ কথাগুলো বলছিলেন হারান মণ্ডল। বয়স তাঁর ৭৭ বছর পেরিয়ে গেছে। আগের ভোটের দিনের স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন ‘জীবুনি মেলা ভোট দিখিছি; কিন্তু এহনকার মত ভোট দেহিনি। আগে ভোট হলি উৎসব উৎসব ভাব ল্যাগতো। কিন্তু এ্যাহন তার কিছুই নেই। মানষির মধ্যে ভোট নিয়ে য্যান কোনো আগ্রহই নেই।’
হারান মণ্ডলের সঙ্গে আজ রোববার কথা হয় ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া এসিজিবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পুরুষ কেন্দ্রে। বেলা পৌনে ১টার দিকে তিনি যখন ভোট দিতে এসেছিলেন তখন ওই কেন্দ্র প্রায় ফাঁকা। আটটি বুথের প্রায় সব সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা, প্রার্থীদের এজেন্ট ভোটারের অপেক্ষায় বসে আছেন। একজন ভোটার কক্ষে প্রবেশ করলেই ব্যস্ত হয়ে উঠছেন তাঁরা। ভোটারের চাপ না থাকায় বাইরে হাঁটহাঁটি করতে দেখা গেছে অনেক এজেন্টকে।
ডুমুরিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে তিনজন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ডুমুরিয়াসহ খুলনার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় একই দিন ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে গত ২৯ মে ওই তিন উপজেলায় ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানায় ভোটগ্রহণ স্থগিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
গুটুদিয়া এসিজিবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পুরুষ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা হারান মণ্ডলের বাড়ি পূর্ব গুটুদিয়া গ্রামে। তিনি বলেন, ‘কেউ চেয়ারম্যান হলিই কী, আর না হলিই কী, আমাগি ভাগ্যির পরিবর্তন হয় না। আমরা আমাগি মতই থ্যাকি যাব। তারপরও মন চাইলো তাই ভোট দিতি আইছি।’
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদা করে রয়েছে নারী কেন্দ্র। সেখানে ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে ভোট দিতে এসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব চন্দনা রানী। তিনি বলেন, ‘বাড়ির কাজ সারি বউমাদের সাথে ভোট দিতি আইছি। কেউ বাড়ি যায়ি আমাগি কাছে ভোট চাইনি। তারপরও ভোটের দিন ভোট না দিতি পারলি মনডা কেমন কেমন য্যান লাগে।’
দুপুর ১২টা থেকে বেলা প্রায় ১টা পযন্ত ওই দুই কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ভোটারের উপস্থিতি খুবই কম। কোনো কক্ষের সামনেই ভিড় নেই। দুই-একজন করে আসছেন আর নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের নারী কেন্দ্রে বুথ রয়েছে আটটি। ২ হাজার ৮৮০ জন ভোটারের মধ্যে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় ভোট পড়েছিল ৭৩টি। তবে ভোট পড়ার হার কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ৪ ঘণ্টায় ওই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৩৬৫টি।
পুরুষ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৯১১ জন। ৮টি বুথে প্রথম ২ ঘণ্টায় ভোট পড়ে মাত্র ৯৬টি। আর ৪ ঘণ্টায় ভোট পড়ে ৫৪৯টি। হঠাৎ করে ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে ৪৫৩টি ভোট পড়ার কারণ জানতে চাইলে কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জিএম আছাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। সকালের দিকে সবাই কাজে বের হয়ে যান। বেলা বাড়ার পর এসে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। ওই দুই ঘণ্টায় একবারে অনেক ভোটারের চাপ পড়েছিল।
দেড়টার দিকে গুটুদিয়ার কমলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, খাঁ খাঁ করছে মাঠ। ভোটার নেই বললেই চলে। ওই কেন্দ্রের ১ হাজার ৯৪৮ জন ভোটারের মধ্যে দুপুর ১২টা পযন্ত ভোট দিয়েছেন ২৫০ জন।
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাধন কুমার মুখার্জি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৬ বছরের চাকরিজীবনে বহু ভোটগ্রহণের সাক্ষী হয়েছি। এমন ভোটার–খরা পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। হয়তো গরমের কারণে মানুষ ভোট দিতে আসছেন না।’
বেলা দুইটার দিকে কমলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন আবু বক্কর। তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এখন ভোট দেওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। মানুষ মনে করে ভোট দিয়ে কী হবে। তা ছাড়া বিএনপি ভোট বর্জন করায় এক শ্রেণির মানুষ ভোট দিতে আসছেন না। আগে ভোট হলে মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ উদ্দীপনা থাকত, এখন তা আর নেই।’