শত শত মানুষ জাহাঙ্গীরের বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বিপরীতে হেঁটেছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এর জেরে তাঁকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ। নানা কারণে অনেকটা একা হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর। তাঁর বাড়িতে আনাগোনা কমে যায় নেতা-কর্মীদের। সেই পরিবেশ এক দিনের ব্যবধানে পাল্টে গেছে। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরদিনই নেতা-কর্মী আর সমর্থকদের ভিড়ে আবার মুখর হয়ে উঠেছে তাঁর বাড়ি।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর ছয়দানা এলাকায় জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সামনের রাস্তায় শতাধিক যানবাহনের জটলা। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় মিষ্টি বিতরণের দৃশ্য। বাড়ির পূর্ব পাশে একটি মাঠে শত শত লোক ভিড় করে আছেন। সেখান থেকে বাড়ির নিচতলার বসার কক্ষ, দ্বিতীয় তলার অফিস কক্ষ, এমনকি তৃতীয় তলায় বসার কক্ষেও নেতা-কর্মীদের জটলা দেখা গেছে।
গতকাল কয়েক দফা জাহাঙ্গীর আলম তাঁর বাড়িতে আসা লোকজনের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। তাই এখনই আমরা কোনো মিছিল বা সমাবেশ করব না। এত হয়রানির পরও আপনারা গোপনে আমার জন্য কাজ করেছেন। মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন, নিজেরা ভোট দিয়েছেন। আমার মাকে আপনারা নিজেদের মা মনে করে পাস করিয়েছেন। সেই ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না।’
গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকা থেকে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে এসেছেন কর্মী নাজমুল ইসলাম। নিজেকে জাহাঙ্গীরের সমর্থক দাবি করে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক হুমকি এসেছে। নানাভাবে ভয় দেখানো হয়েছে। তারপরও আমরা মাঠ ছাড়িনি। জায়েদা খাতুনের টেবিলঘড়ি প্রতীকের জন্য ভোট চেয়েছি। মায়ের জয় মানে জাহাঙ্গীর আলমের জয়। এ জয়ে আমরা অনেক খুশি।’
নগরের গাছা এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নানা কারণে মাঝে কিছু সময় নেতার (জাহাঙ্গীরের) বাড়িতে আসতে পারি নাই। পুলিশ ঝামেলা করেছে। দলের বড় নেতারা বকাঝকা করেছে, কিন্তু এখন সেই ভয় আর নেই।’
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু ও জেলার কয়েক গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুরের রাজনীতি। এর জেরে প্রথমে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারান জাহাঙ্গীর। পরে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাঁকে।
এর পর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুর মহানগরীর ছয়দানা এলাকায় জাহাঙ্গীর আলমের নিজ বাড়ি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অনেকে। প্রায় একা হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর। একপর্যায়ে তাঁর বাড়িতে নেমে আসে সুনসান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাহাঙ্গীরকে ক্ষমা করে দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে দলে ফিরতে পারলেও মেয়র পদে ফিরতে পারেননি তিনি।
এরই মধ্যে গাজীপুর সিটি নির্বাচন চলে আসে। এবারও মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চান জাহাঙ্গীর। তবে দল বেছে নেয় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে। এরপর স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন জাহাঙ্গীর। পাশাপাশি মেয়র পদে মা জায়েদা খাতুনের নামেও মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে ঋণখেলাপির কারণে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল হয়, তবে মায়েরটি টিকে যায়। মা জায়েদা খাতুনের হয়ে নির্বাচনে মাঠে সরব ছিলেন, লড়ে যান জাহাঙ্গীর। গত বৃহস্পতিবার ঘরে ফেরেন জয় নিয়ে।
টেবিলঘড়ি প্রতীকের জায়েদা খাতুন ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করেছেন। জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
জায়েদা খাতুন জেতার পরদিনই জাহাঙ্গীরের বাড়িতে আবার মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। শত শত নেতা ছয়দানা এলাকায় বাড়িটিতে আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, রয়েছেন কাউন্সিলর পদে নির্বাচিতরাও।
বিষয়টি স্বীকার করে নগরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার মতো আরও অনেকে বিভিন্ন সময় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন।’
নেতা-কর্মীদের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দরজা নেতা-কর্মীদের জন্য সব সময় খোলা। মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। আমিও তাঁদের ভালোবাসি। সেই ভালোবাসার প্রতিদান এবার নির্বাচনে তাঁরা আমাকে দিয়েছেন। আমি ও আমার মা তাঁদের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করব।’