সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেড় শ বছরের পুরোনো ভবনের নকশা অপরিবর্তিত রেখে সবকিছুতেই নতুনের ছোঁয়া লাগবে। জাদুঘরের পেছনের খোলা জায়গায় শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে থাকবে খেলাধুলার সরঞ্জাম।
জাদুঘর পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী এই তথ্য জানান। গত বৃহস্পতিবার জাদুঘর পরিদর্শন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। তিনি জাদুঘরটি ঘুরে দেখেন এবং বিভিন্ন জিনিসপত্রের ছবি তুলে নেন। এ সময় তিনি গ্রে ডি স্টুডিওর করা জাদুঘরের প্রস্তাবিত সংস্কারের নকশা দেখেন।
উপস্থিত ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাসনা জাহান খানম, যুগ্ম সচিব মো. মিজানুর রহমান, উপসচিব কাজী নুরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। এ সময় জানানো হয়, জাদুঘরের ডান দিকের ভবনে থ্রিডি হল করা হবে। যেখানে আধুনিক ডিভাইসের মাধ্যমে সবাই শিক্ষণীয় থ্রিডি ভিডিও দেখতে পারবেন। এর মাধ্যমে চাইলে কেউ ডাইনোসর থেকে শুরু করে সমুদ্রের নিচের পরিবেশ অনুভব করতে পারবেন। বাঁ দিকের ভবনে থাকবে আধুনিক এক্সিবিশন হল। এ ছাড়া একাধিক ফুড কর্নার থাকছে বিভিন্ন জায়গায়। ডিজাইন ও কাজ করা প্রতিষ্ঠান গ্রে ডি স্টুডিও বলছে, এখন বাস্তবায়নের যোগ্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
গ্রে ডি স্টুডিওর ডিরেক্টর ওয়ালিউল আলিম বলেন, ‘এই জাদুঘর হেরিটেজের অংশ। এর নকশার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। বর্তমানে জাদুঘরের ভেতরের বিভিন্ন উপকরণ ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। আমরা জাদুঘরের উপকরণ খুব সুন্দরভাবে ডিসপ্লে করার ব্যবস্থা রেখেছি। এ ছাড়া শিশুদের বিনোদন, শিক্ষণীয় উপকরণ, আধুনিক হল, ফুড কর্নারের ব্যবস্থা করেছি। এখন যাচাই-বাছাই চলছে। শেষ হলে আনুমানিক খরচ বলতে পারব।’
সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ বলেন, সুনামগঞ্জের একমাত্র জাদুঘর এটি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাদুঘরের দেখভাল করে থাকে। জেলা প্রশাসন বেসরকারিভাবে জাদুঘরটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ধন্যবাদ জানাই তাদের। তিনি আরও বলেন, ‘খুব সহজ হয় এই জাদুঘর যদি আমাদের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে গ্যাজেট করে দেওয়া যায়। এতে নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা আমাদের খুবই সহজ হয়ে যাবে। তবে স্থানীয় ব্যক্তিরা এটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে দেবে কি না, এই মতামতের দরকার আছে। এটি যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই সরকারকেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার থেকে পূর্ব দিকে ডিএস রোড ধরে মিনিট পাঁচ হাঁটলে ডান পাশে এই জাদুঘর। জাদুঘর যে ঘরে, সেটি একসময় জেলা ‘কালেক্টরেট’ ভবন ছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় শহরের অন্যত্র স্থানান্তর হলে একসময় ভবনটি অযত্ন-অবহেলায় ‘পরিত্যক্ত’ হয়ে পড়ে।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন এ জেলার বাসিন্দা কবি ও গবেষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। তিনি ২০১৪ সালের শেষ দিকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীকে এটিতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ধারণাপত্রসহ একটি চিঠি দেন। এরপর ভবন সংস্কারের কাজ শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি।
জাদুঘরের পাঁচটি কক্ষে জেলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি; পরিবেশ ও প্রকৃতি, জীবন ও জীবিকা—এই পাঁচ ভাগে গড়ে তোলা হয়েছে সংরক্ষণ ও সংগ্রহ। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে রয়েছে জেলার ১ হাজার ৬৯১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নিজের হাতে লেখা ডায়েরি। এসব ডায়েরিতে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার ছবি, হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ, পরিচয়ের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার বর্ণনা, যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা রয়েছে। এই বীরযোদ্ধাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে এখানে।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি পর্ব এখানে সাজিয়ে রাখা। আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, জাতীয় চার নেতা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষাশহীদদের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস। সংস্কৃতি বিভাগে জেলার মরমি সাধকদের আলোকচিত্র, তাঁদের গানের পাণ্ডুলিপি, ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সামগ্রী। সুনামগঞ্জের রূপ-সৌন্দর্যের কিছু আলোকচিত্র ও মানুষের ব্যবহৃত পুরোনো তৈজসপত্র দেখা গেল প্রকৃতি ও পরিবেশ বিভাগে। জীবন-জীবিকা বিভাগে হাওরে মাছ ধরা এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয় বাহারি যন্ত্র সংরক্ষণ করা। এসব এখন হাওর এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে হাওরের মিঠাপানির ৩৬ প্রজাতির মাছ ছোট-বড় বয়ামে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
সংগ্রহ বাড়ানো, সৌন্দর্যবর্ধন ও সংস্কারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—এমনটাই জানান জাদুঘর পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি ও জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। এখানে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা, স্যুভেনির শপ হবে। ভবনটির যেহেতু নিজস্ব একটা ঐতিহ্য আছে, তাই এটির আদল পরিবর্তন করা হবে না বলে জানান তিনি।