কমিটি গঠনের পর বিরোধ বেড়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের মধ্যে গত পাঁচ মাসে অন্তত সাতবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আবাসিক হলের কক্ষ ভাঙচুর, নিয়োগের জন্য উপাচার্যের দপ্তর ভাঙচুর, অবরোধ, কর্মকর্তাকে হেনস্তাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে। তবে এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা সংগঠন থেকে এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কার্যকর পদক্ষেপ।

ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমিটি গঠনের পর থেকে সংগঠনটিতে নতুন করে বিরোধ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিকবার ক্যাম্পাস অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, সভাপতির কুশপুত্তলিকা দাহসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন উপপক্ষের নেতা-কর্মীরা।

সর্বশেষ হোটেলে খাবার টেবিলে বসা নিয়ে হাতাহাতি থেকে গত বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার দুপুরে দুই দফায় সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের দুটি উপপক্ষ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও এক পুলিশ সদস্যসহ আহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের এসব ঘটনার বিচার প্রক্রিয়াধীন। শিগগিরই সংঘর্ষ, মারামারি, ভাঙচুর, কর্মকর্তাকে হেনস্তাসহ সব ঘটনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চলতি বছর সাতবার সংঘর্ষ

চলতি বছর হলের কক্ষ দখল, আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে অন্তত সাতবার। দরপত্র ছাড়া পুরোনো মালামাল না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাকে হেনস্তা, মূল ক্যাম্পাসে ফেরার দাবিতে চারুকলার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারধরসহ নানা ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে।

চলতি বছরের ৫ ও ৬ জানুয়ারি পরপর দুই দিন রাতে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল শাখা ছাত্রলীগের দুটি উপপক্ষ। এতে উভয় পক্ষের ১১ জন আহত হন। ৭ ফেব্রুয়ারি সিনিয়রের সামনে ধূমপান নিয়ে তর্কাতর্কিতে জড়িয়েছিল ছাত্রলীগের তিনটি উপপক্ষ। এতে উভয় পক্ষের আটজন আহত হয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের কক্ষ দখল নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন আহত হন। একই ঘটনার জের ধরে আবার ২৪ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয়েছেন একজন। ৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় স্টোর (গুদামঘর) থেকে পুরোনো মালামাল দরপত্র ছাড়াই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের হেনস্তারও অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা সমিতির নেতারা।

দুবার অবরোধ

গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় ৩৭৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে। কমিটি ঘোষণার পরই পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা চারটি হলের প্রায় ৩০টি কক্ষ ভাঙচুর করেন। ওই দিন রাতেই মূল ফটকে তালা দিয়ে অবরোধের ডাক দেন একাংশের নেতা-কর্মীরা। অবরোধ অব্যাহত থাকে ২ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। এ কারণে সে সময় ৯টি বিভাগের ১১টি চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এরপর আবার ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে একই দাবিতে অবরোধ করেন ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষ। এক দিন চলা এ অবরোধেও স্থগিত হয়েছিল ৯টি বিভাগের ১১টি চূড়ান্ত পরীক্ষা।

নিয়োগেও প্রভাব বিস্তার

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে নিয়োগ নিয়ে আগেও বিতর্কে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গত ৩১ জানুয়ারি ছাত্রলীগের সাবেক নেতার নিয়োগ না দেওয়ার প্রতিবাদে উপাচার্যের কার্যালয় ভাঙচুর করেছিল ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। ভাঙচুর চলাকালে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও সিন্ডিকেট সদস্যরা ভেতরের একটি কক্ষে অবস্থান করছিলেন। এরপর ১ ফেব্রুয়ারি আবার রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে হট্টগোল করেছিলেন তারা। ২৩ জানুয়ারিও রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা এক প্রার্থীকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।

সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের প্রতি অনাস্থা

কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার পর থেকেই পদ বিক্রি, বিবাহিত চাকরিজীবীদের পদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ এনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন ছয়টি উপলক্ষ। তারা কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে গত বছর ১০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন, ৮ সেপ্টেম্বর গণস্বাক্ষর কর্মসূচি, ৬ সেপ্টেম্বর মানববন্ধন ও ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। সর্বশেষ গত ৯ মে বিক্ষোভ করেছিলেন এ নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া গত ১১ মে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ এনে সভাপতি রেজাউল হকের পদত্যাগ দাবি করেছে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। পাশাপাশি রেজাউলের কুশপুত্তলিকাও দাহ করেছেন নেতা-কর্মীরা। একই দাবিতে ২৩ মে দিবাগত রাতেও রেজাউলের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন আরেকটি পক্ষের নেতা-কর্মীরা।

শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও ভার্সিটি উপপক্ষের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালে দুই সদস্যের কমিটি গঠনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মধ্যে প্রায় ১৬০ বার সংঘর্ষ হয়েছে। বর্তমান শীর্ষ দুই নেতা শুরু থেকেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। চার বছরেও একবার কর্মী সভা করতে পারেননি। সংগঠনকে গতিশীল রাখার জন্য যা দরকার, তা করেননি। নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য যা করা প্রয়োজন, তা এ দুই নেতা করে গেছেন। দলের উপকারে কাজ করার জন্য মনোনিবেশ তাঁদের ছিল না।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান এ কমিটি গঠন হওয়ার পর তাঁদের নেতৃত্বের কারণে সংঘর্ষ আগের তুলনায় অন্তত ৭০ ভাগ কমেছে। কর্মী সভা না করতে পারার বিষয়ে জানতে চাইলে ইকবাল হোসেন বলেন, তাঁরা তাঁদের মতো কর্মী সভা করেছেন। কেউ যদি কর্মী সভায় না এসে এসব অভিযোগ করেন, তাহলে এটি দায়িত্বহীন কথা। পকেট ভারীর জন্য নয়। তারা সংগঠনের গতিশীলতার জন্যই কাজ করেছেন। আগের কমিটির চেয়ে তাঁদের কমিটি গতিশীল রয়েছে।

একই দাবি করে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন যদি দায়িত্ব পালন করে, তাহলে এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটার সুযোগ থাকবে না। আর সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ব্যবস্থা নিত, তাহলে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তবু তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে সংঘর্ষে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করবেন।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নেতা-কর্মীদের সংগঠনের শৃঙ্খলা মেনে চলা ও একাডেমিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সর্বোচ্চ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে সাময়িক ব্যত্যয় ঘটে। কমিটির মেয়াদ অনেক দিন হলে এমনটি হয়। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিগগিরই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।