মেয়েদের ছবি হাতে শচীন্দ্র ও পুস্পারানী শীল
মেয়েদের ছবি হাতে শচীন্দ্র ও পুস্পারানী শীল

নতুন ঘর হয়েছে, তবু ক্ষত শুকায়নি

দোতলা মাটির বাড়িটি এখন আর নেই। সেখানে নতুন দালান উঠেছে। সামনের আঙিনারও অনেক কিছু বদলে গেছে। তবু বাড়িটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবারের জন্য হলেও গ্রামবাসীর চলার গতি শ্লথ হয়ে যায়। মনে পড়ে সেই রাতের নারকীয় ঘটনার কথা। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ার মানুষজন এবং তেজেন্দ্র লাল শীলের বেঁচে থাকা স্বজনেরা এখনো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

২০ বছর আগে, ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে তেজেন্দ্র লালের দোতলা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয় তাঁর পরিবারের ১১ সদস্যকে। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান গৃহকর্তা তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), তাঁর স্ত্রী বকুল শীল (৬০), ছেলে অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল; তেজেন্দ্র লালের ভাইয়ের মেয়ে বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), এনি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা তেজেন্দ্রর ভায়রা ভাই দেবেন্দ্র শীল (৭২)। সেদিন তেজেন্দ্রর ছেলে বিমল লাফিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সে সময় ঘটনাটি দেশ-বিদেশে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে যান ওই সময় জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় প্রকাশিত পোস্টার।

সম্প্রতি সাধনপুরের শীলপাড়ার বাড়িটিতে গেলে নীরবতা ঘিরে ধরে। বাড়িটিতে কর্মব্যস্ততার কোনো লক্ষণই যেন নেই। বাড়িতে পাওয়া গেল তেজেন্দ্রর ভাই শচীন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী পুষ্পা রানীকে। সেদিনের ঘটনায় এই দম্পতির তিন মেয়ে বাবুটি, প্রসাদি ও এনি আগুনে পুড়ে অঙ্গার হন। এর পর থেকে এক দিনের জন্যও মেয়েদের কথা ভুলতে পারেননি। মনে হয় তাঁরা এখানেই আছেন। অথচ ২০ বছর হয়ে গেছে।

শচীন্দ্র শীল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দোতলা মাটির ঘর ছিল। ওই ঘরে আমার দুই ভাই ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বসবাস করত। ওই সময় আমি আলাদা একটি ঘর পাকা করার কাজে হাত দিই। কিন্তু ঘরের কাজ শেষ না হওয়ায় থাকার জায়গার সংকট ছিল। এ কারণে রাতের বেলা তিন মেয়েকে ভাইয়ের ঘরে থাকতে দিই। আর এটাই কাল হলো। আমার তিন মেয়ে পুড়ে মারা গেল ঘরটিতে।’

ঘটনার সাক্ষী সেই দোতলা মাটির বাড়ির উত্তর পাশে তেজেন্দ্রর ছেলে নির্মলের ঘর এবং দক্ষিণ পাশে সুনীলের ঘর করা হয়েছে। উত্তর পাশে সুনীলের ঘরের সামনে স্মৃতিসৌধ। এর পশ্চিমে তেজেন্দ্রর ছেলে বিমলের ঘর। ঘরগুলোর কাজ শেষ হলেও রং করা হয়নি। সেগুলোয় তালা লাগানো। কাজ শেষ হলে ঘরগুলোয় উঠবেন মালিকেরা।

সেদিনকার ঘটনায় তিন মেয়েকে হারিয়েছেন শচীন্দ্র শীল ও পুস্পারানী শীল। শ্মশানের সমনে গেলে আজও মনে হয় মেয়েরা ডাকছে। গত শুক্রবার সকালে বাঁশখালীর সাধনপুরে

উঠানে গরুর জন্য ঘাস কাটছিলেন বাবুটি, প্রসাদি ও এনির মা পুষ্পা রানী। তিনি বলেন, ‘এত বছর কেটে গেছে, কিন্তু আমরা এখনো সেই দিনটিতে রয়ে গেছি। ঘর থেকে বের হলে, ঘরের পাশে শ্মশানের কাছ দিয়ে হাঁটার সময় মনে হয় মেয়েরা ডাকছে। আমাদের স্বাভাবিকই জীবন বলে কিছু নেই।’ কথা বলতে বলতে আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন পুষ্পা রানী।

শ্মশানের পাশে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসেন শচীন্দ্র শীল। বার্ধক্যের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে গেলেও নিহত তিন মেয়ের কথা বলে যাচ্ছিলেন অনর্গল। কথা বলতে বলতে শ্মশানের নামফলকে মেয়েদের নাম পড়ছিলেন।

শচীন্দ্র বলেন, ‘আমার ঘরটি পাকা করার কাজ করছিলাম। ঘরের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়। ভেবেছিলাম নতুন ঘরে মেয়েরা উঠবে। থাকতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো না।’

কথা হয় প্রতিবেশী হেমেন্দ্র শীলের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেই রাতের কথা ভুলতে পারেন না তিনি। একটি পরিবারের ১১ সদস্যকে একসঙ্গে পুড়িয়ে মারা যায়, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এখনো।

ওই ঘটনার পর এলাকার সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর মাঝে যে আতঙ্ক ভর করেছিল, তা এখনো কাটেনি বলে হেমেন্দ্র শীল জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা ৬০টির মতো পরিবার এখানে বসবাস করি। ঘটনার পর এখানে একটা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আমরা চাই, এটি স্থায়ী করা হোক। কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমরা এ দেশের মানুষ, এ দেশেই থাকতে চাই।’

এলাকার মুসলমান প্রতিবেশীরাও ওই ঘটনার কথা স্মরণ করেন এখনো। মো. মহিউদ্দিন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানে আমরা হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে বসবাস করতে চাই। এমন নৃশংস ঘটনা যেন আর না ঘটে। ঘটনার পর আমরাও আগুন নেভাতে এগিয়ে আসি।’

এদিকে এ ঘটনার পর কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি তিন মেয়ে হারানো শচীন্দ্র শীল। ২০২২ সালে শচীন্দ্র এবং ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর ছেলে সনজিৎ আর্থিক সহায়তা চেয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করলেও এখনো কোনো সহায়তা পাননি।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা

হত্যাকাণ্ডের পর নিহত তেজেন্দ্র শীলের ছেলে বিমল শীল হত্যা মামলা করেন। তিন দফা অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হলেও বাদীর নারাজির কারণে সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি বিএনপি নেতা আমিনুর রহমানসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। মামলার সাক্ষী করা হয়েছে ৫৭ জনকে। এর মধ্যে গত ২০ বছরে মাত্র ২৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১৮ জন পলাতক এবং ১৮ জন জামিনে আছেন। কারাগারে আছেন একজন। আরেকজনের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।