পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে স্কুলে পড়ালেখার ‘হাসপাতাল’

খেলার ছলে পড়ালেখা চলে ‘হাসপাতালে’। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিংহবীজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

স্কুলের পিছিয়ে পড়া ছয় শিক্ষার্থী নিয়ে একেকটি দল। প্রতিটি দলে নিয়োগ করা হয়েছে একজন প্রতীকী চিকিৎসক। যে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদেরই সহপাঠী। তবে পড়ালেখায় অন্যদের চেয়ে ভালো। পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করে সে। প্রতিদিন স্কুলের টিফিনের পর এক ঘণ্টা চালু থাকে ‘রিডিং অ্যান্ড রাইটিং হসপিটাল’। বাকি সময় সবার সঙ্গে ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা। ‘চেকিং রুমে’ যে শিক্ষার্থী সবচেয়ে ভালো করে, তাকে দেওয়া হয় ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ডে’ পুরস্কার।

করোনায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন ‘পড়ালেখার হাসপাতাল’ চালু করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজীব মাহমুদ মিঠুন। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়ছে। তারা ভালোভাবে পড়তে ও লিখতে পারছে।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আলী রাজীব মাহমুদ গত বছরের মে মাসে ইউএনওর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যান। তখন তিনি দেখতে পান, শহরের বাইরের স্কুলের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারছে না। ইংরেজি ও অঙ্কে তারা আরও দুর্বল। করোনাকালে স্কুল বন্ধ ও পরীক্ষা না থাকায় পড়াশোনা থেকে দূরে ছিল শিক্ষার্থীরা। এ কারণে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে। পরে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব শিক্ষার্থীর জন্য ‘রিডিং অ্যান্ড রাইটিং হসপিটাল’-এর উদ্যোগ নেন ইউএনও। উপজেলার ৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ‘হাসপাতাল পরিচালনার’ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন ৩৯টি স্কুলে পুরোদমে ‘হাসপাতাল’ চালু আছে।

শ্রীমঙ্গলের ৩৯টি স্কুলে পুরোদমে চালু আছে পড়ালেখার ‘হাসপাতাল’। সম্প্রতি উপজেলার সিংহবীজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

ইউএনও আলী রাজীব মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ঠিকভাবে পড়তে পারছিল না। শহরের বাইরের স্কুলেও একই সমস্যা দেখতে পান তিনি। এতে শিশুদের মনের ওপর চাপ তৈরির পাশাপাশি স্কুলে ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়ছিল। পরে ৩৯টি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে নিয়ে ‘রিডিং অ্যান্ড রাইটিং হসপিটাল’ করার উদ্যোগ নেন। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়ছে। তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি স্কুলে এ কার্যক্রম চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। আশা করছেন, এ হাসপাতালের মাধ্যমে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলের সিংহবীজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ‘রিডিং অ্যান্ড রাইটিং হসপিটালের’ জন্য দুটি কক্ষ নেওয়া হয়েছে। একটি কক্ষে ছয়টি দলে ৫ জন করে ৩০ শিক্ষার্থী খেলার ছলে পড়ছে। খেলার ছলে অক্ষর, যুক্তাক্ষর, ইংরেজি ওয়ার্ড, অঙ্ক শেখাচ্ছেন একজন শিক্ষক। পাশাপাশি প্রতীকী চিকিৎসকেরা নিজ নিজ দলকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে শেখাচ্ছে। অন্য কক্ষের নাম দেওয়া হয়েছে ‘চেকিং রুম’। প্রথম কক্ষে শিখে আসা বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছে কি না, সেটা চেক করছে ‘চিকিৎসক’। দেয়ালে টাঙানো অক্ষর, শব্দ, বাক্য এবং পত্রিকা স্ট্যান্ডে রাখা বাংলা পত্রিকা, গল্পের বই পড়ছে শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের যারা পড়তে পারছে, তাদের ‘ছাড়পত্র’ দেওয়া হচ্ছে। আবার তাঁদের জায়গায় নতুন শিক্ষার্থী আসছে।

দেয়ালে টাঙানো শব্দ, বাক্য কিংবা স্ট্যান্ডে রাখা পত্রিকা পড়তে পারলে তবেই মেলে ছাড়পত্র। সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিংহবীজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মলয় কান্তি তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিডিং অ্যান্ড রাইটিং হসপিটাল’ স্কুলের জন্য অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনার বাইরে ছিল। তারা পড়াশোনায় পিছিয়ে আছে। হাসপাতালের মাধ্যমে তাঁরা শিক্ষার্থীদের উন্নতি করার চেষ্টা করছেন। উদ্যোগটি প্রতিটি স্কুলেই করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

স্কুলে এমন ‘হাসপাতাল’ খুলতে তেমন খরচ নেই উল্লেখ করে ইউএনও আলী রাজীব মাহমুদ বলেন, ডিজিটালি করলে ৬ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যায়। কাগজ দিয়ে করলে খরচ নেই বললেই চলে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ‘হাসপাতাল’ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। পুরো বিষয়টি মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি চান, দেশের সব স্কুলে এমন কার্যক্রম চালু হোক।