নবজাতকটি কখনো নানি-দাদি, আবার কখনো বাবার কোলে থাকছে। বাড়িতে শত মানুষের ভিড়। তবে এই ভিড়েও শিশুটির চোখ খুঁজে ফিরছে তার মাকে। মায়ের স্পর্শ কিংবা আদর পেতে যেন শিশুটি ব্যাকুল। তার মা সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা (২১) সন্তান জন্ম দেওয়ার পাঁচ ঘণ্টার পরই চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার অজপাড়াগাঁ লক্ষ্মীনাথপুর। সাতক্ষীরা শহর থেকে গ্রামটি ৪৫ কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামের নূর আলী আর আবিরন বিবি দম্পতির দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রাজিয়া। গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে রাজিয়ার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই শতক জমির ওপর আধপাকা তিনটি ছোট ছোট ঘর। উঠানে কয়েক শ নারী-পুরুষ, সবাই শোকার্ত। কেউই রাজিয়ার অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না। রাজিয়া ছিলেন গ্রামের সবার প্রিয়। এই বাড়িতেই গত বুধবার রাত ১০টার দিকে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন রাজিয়া। ওই দিন দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাবার বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
রাজিয়ার বাবা নূর আলী মারা গেছেন, বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে থাকেন শুধু মা আবিরন বিবি ও বড় ভাই ফজলুল হক। গতকাল সকালেই রাঙামাটির কাপ্তাই থেকে আসেন রাজিয়ার শাশুড়ি রোকেয়া খাতুন, স্বামী ইয়াম রহমান ও ভাশুর সিয়াম রহমান।
রাজিয়ার নবজাতক সন্তানকে দেখা গেলে নানি আবিরন বিবির কোলে। তাঁর কোল থেকে থেকে দাদি রোকেয়া খাতুন নবজাতক নাতিকে নিয়েই আদর করা শুরু করেন। তখন বাড়িতে অনেক মানুষ। তার মধ্যে নবজাতকের চোখ খুঁজছে তার মাকে। ৩০-৩২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও অবুঝ শিশু জানে না, তার মাকে আর কখনো পাবে না। স্বজন-প্রতিবেশীরা বিলাপ করছিলেন, আর এ কথাই বলছিলেন। শিশুটি বড় হয়ে জানবে তার মায়ের সব কীর্তির কথা, ফুটবলে হার না মানার গল্প। তবে আজীবন মায়ের আদর না পাওয়ার কষ্ট থেকেই যাবে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজিয়ার স্বামী ইয়াম রহমান অনূর্ধ্ব-১৮ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও চট্টগ্রামের কাপ্তাই এলাকার একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা। চট্টগ্রামের কাপ্তাই এলাকার বাসিন্দা ইয়াম ঢাকায় কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতেন। সেখান থেকে ২০১৮ সালের দিকে রাজিয়ার সঙ্গে পরিচয়। ২০২০ সালে তাঁরা পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। বিয়ের পর জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন রাজিয়া। তারপরও তিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ক্লাবের হয়ে লিগ খেলেছেন।
অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর গত বছর আগস্ট মাসের শেষের দিকে রাজিয়া ঢাকা থেকে চলে আসেন মায়ের কাছে। তখন থেকে তিনি মায়ের কাছে ছিলেন। রাজিয়ার পরিবারের সদস্যরা সবাই অশিক্ষিত ও অসচেতন। গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজিয়ার প্রসববেদনা শুরু হয়। স্থানীয় ধাত্রী দিয়ে তাঁর প্রসব করানো হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এক ছেলেসন্তান জন্ম দিয়ে রাজিয়া মা হন। পৃথিবী আলো দেখার পর নবজাতক চিৎকার করে যখন কাঁদছিল, মা রাজিয়া তার গায়ে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কান্না থামায়। এর পাঁচ ঘণ্টা পর রাজিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
রাজিয়ার বড় ভাই ফজলুল হক (২৩) বলেন, রাজিয়া ফুটবল খেলা শুরু করেন শৈশব থেকেই। তিনি আর রাজিয়া পিঠাপিঠি ভাই–বোন। ফজলুল গরু চরাতে যেতেন বিলে। তাঁর সঙ্গে যেতেন রাজিয়া। বিলে আরও অনেকে গরু চরাতে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে বিলের মধ্যে রাজিয়ার ফুটবলে হাতেখড়ি। ছোটবেলায় গাছে ওঠা, মাছ ধরা, সাইকেল চালানোসহ দুরন্তপনা ছিল রাজিয়ার মজ্জাগত। ফুটবল কেনার মতো সামর্থ্য না থাকায় কখনো বাতাবিলেবু আবার কখনো খড়কুটা দিয়ে ফুটবল তৈরি করে খেলতেন।
রাজিয়ার বড় বোন নাজমা খাতুন (৩০) ভাই–বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। তিনি বলেন, খেলার পর পেটপুরে খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না তাঁদের। তারপরও থেমে থাকেননি। খেয়ে না-খেয়ে বোনকে নিয়ে ছুটেছেন কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা এমনকি খুলনায় খেলার মাঠে তালিম নিতে। সাতক্ষীরায় কোচ আকবর আলীর (২০২২ সালে প্রয়াত) জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে দিনের পর দিন বাড়িতে আসতে পারেননি রাজিয়া। মাঝেমধ্যে তিনি গিয়ে আদরের ছোট বোনকে দেখে এসেছেন।
২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত কোচ আকবরের তত্ত্বাবধানে ছিলেন রাজিয়া। তারপর ঢাকায় চলে যান। তার পর থেকে বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪, ১৫, ১৬, ১৮ ও ১৯ দলে খেলেছেন। দেশের বাইরে খেলেছেন ভারত, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কারও নিয়েছেন। ২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় নারী ফুটবল দলে খেলেছেন। কিন্তু সাফজয়ী এ ফুটবলারকে নিয়তির কাছে হেরে গিয়ে শুধু ফুটবল থেকে নয়, পৃথিবী থেকেই চিরবিদায় নিতে হলো।