নরসিংদীর মনোহরদীতে চোর সন্দেহে কামাল মিয়া (৩৫) নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ‘জীবিত ছেড়ে দেওয়ার’ কথা বলে তাঁর বাবা ও ভাইয়ের কাছে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলেন হত্যাকারীরা। তবে কামালকে ‘চোখে না দেখে’ মুক্তিপণ দিতে রাজি হয়নি পরিবার। নিহত কামালের বাবা মো. হোসেন মিয়া ও ছোট ভাই মো. কাজল মিয়া প্রথম আলোকে এসব কথা বলেছেন।
শনিবার রাতভর মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের মহিষাকান্দি গ্রামে চোর সন্দেহে কামাল মিয়াকে উপর্যুপরি পেটান স্থানীয় একদল ব্যক্তি। এরপরও প্রায় ১২ ঘণ্টা তিনি বেঁচে ছিলেন। রোববার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল পেয়ে বিকেলে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাতভর থানায় রেখে গতকাল সোমবার ভোরে লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ।
নিহত কামাল মিয়া নরসিংদী সদর উপজেলার চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামের মো. হোসেন মিয়ার বড় ছেলে। রায়পুরার চরআড়ালিয়া ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ বসবাস করতেন তিনি। তিনি কখনো মাছের ব্যবসা, কখনো কাঠমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ভাই মো. কাজল মিয়া রোববার রাতেই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। প্রাথমিক তদন্ত শেষে সোমবার বিকেলে ইউপি চেয়ারম্যানের নাম বাদ দিয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ করে মামলা নেয় পুলিশ। আসামিরা হলেন চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মৃত তোতা মিয়ার ছেলে মো. ইসহাক (৩৫), তোতা মিয়ার ছেলে মো. হারুন অর রশিদ (৪২) এবং মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মোসাদ্দেক মিয়া (৩২)। তিনজনেরই বাড়ি মহিষাকান্দি গ্রামে।
শনিবার রাতে ঠিক কখন কামাল মিয়াকে স্থানীয় ব্যক্তিরা আটক করেন, এ নিয়ে দুই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, রাত ১০টার কাছাকাছি সময়েই তাঁকে আটকে ফেলা হয়। অন্যদিকে যাঁরা পিটুনি দিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা বলছেন, রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে তিনি আটক হন। তবে পিটুনিতে নেতৃত্ব দেন ইসহাক, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। ঘটনাস্থলও তাঁর বাড়িসংলগ্ন সড়কে।
স্থানীয় অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মহিষাকান্দি গ্রামের মোসাদ্দেক মিয়ার অটোরিকশার মোটর ও যন্ত্রাংশ চুরি হয়। গত শনিবার রাতে তাঁর বাড়ির সামনের সড়ক ধরে দুজন অপরিচিত লোক হেঁটে যাওয়ার সময় স্থানীয় একজন তাঁদের চোর ভেবে চিৎকার শুরু করলে ইসহাক বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। আরও লোকজন জড়ো হয়ে ওই দুই ব্যক্তিকে ঘিরে ধরলে পুকুরে লাফিয়ে পড়ে একজন পালাতে সক্ষম হলেও কামালকে আটক করেন তাঁরা। তাঁকে চোর সন্দেহে ইসহাকের বাড়ি ও সড়কসংলগ্ন একটি গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। তাঁর দুই হাত ও পেট বরাবর এতটাই শক্ত করে বাধা হয়েছিল, এসব জায়গার বেশ অনেকখানি দেবে গিয়েছিল। রাতভর তাঁর সারা শরীরে লাঠি দিয়ে নৃশংসভাবে পেটানো হয়। এত পিটুনিতে কামাল মিয়া আধমরা হয়ে গিয়েছিলেন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা আরও জানান, সকালে সেখানে গিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রউফ ও ইউপি সদস্য মো. দুলাল মিয়া কামালের এমন অবস্থা দেখে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে বলেন। আটটার দিকে তাঁকে মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। স্বজনহীন কামাল মিয়াকে নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেও ঝামেলা এড়াতে মাঝপথ থেকে বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে ফিরে আসেন তাঁরা। তখনো বেঁচে ছিলেন কামাল। বেলা দেড়টার দিকে তাঁর বাবা ও ভাই সেখানে যাওয়ার আগমুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে মনোহরদী থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে।
নিহত কামালের বাবা মো. হোসেন মিয়া ও ভাই মো. কাজল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, কামালকে আটকে রাখা হয়েছে শুনে আলোকবালী থেকে তাঁরা দুজন গতকাল বেলা দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে যান। যাওয়ার পর ইসহাক তাঁদের কামালের কাছে যেতে না দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যান। প্রায় এক ঘণ্টা তাঁদের বসিয়ে রেখে তিনি বলেন, এক লাখ টাকা না দিলে তাঁকে জীবিত অবস্থায় ছাড়বেন না। লাউড স্পিকারে চেয়ারম্যান আবদুর রউফকে কল দিয়ে কথা বলেন ইসহাক। অবস্থা বেগতিক দেখে কামালের স্ত্রীকে কল দিয়ে গয়না বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করতে বলেন হোসেন মিয়া ও কাজল মিয়া। টাকার জোগাড় হচ্ছে না দেখে ইসহাক তাঁদের বলেন, ‘লাখ টাকা লাগবে না, ৩০ হাজার টাকা দেন, কামালকে ছেড়ে দিচ্ছি।’ টাকা দিতে রাজি হয়ে বাবা হোসেন মিয়া ছেলেকে একনজর দেখতে চাইলে বাধা দেন ইসহাক। টাকা হাতে পাওয়ার পরই ছেলের কাছে নিয়ে যাবেন বলে জানান। একপর্যায়ে কাজল ৯৯৯-এ কল দিয়ে সাহায্য চান। এরপরই পুলিশ সেখানে আসে। অথচ তারা সেখানে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক আগেই কামাল মারা গিয়েছিল।
মো. কাজল মিয়া বলেন, ‘যখন ভাইয়ের লাশ প্রথম দেখি, একটি গাছের নিচে উল্টো (মুখ নিচের দিকে, পিঠ ওপরের দিকে) হয়ে শোয়া ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থা থেকে বাঁধন খোলার পর যেমনে পড়ছে, সেভাবেই ছিল তাঁর লাশ। তাঁর পরনে ছিল শুধু একটা শর্ট প্যান্ট, গাছের পাশেই পড়ে ছিল লুঙ্গি। ওই সময় ইসহাককে জাপটে ধরে আমি বলেছি, “আপনারা আমার ভাইটারে এমনে মাইরা ফেললেন কেন? যদি কোনো অপরাধ কইরা থাকে, থানায় দিয়া দিতেন। আমগরে ফোন দিতেন? আমরা বিচার করতাম। এভাবে জলজ্যান্ত মানুষটারে মেরে ফেললেন আপনারা? তাঁর পাঁচ বছর ও আট মাস বয়সী দুই সন্তানরে আপনারা এতিম কইরা দিলেন?” ওই সময় ইসহাক আমার কাছে হালকা-পাতলা মারধরের কথা স্বীকার করেন। একপর্যায়ে চেয়ারম্যানের ইশারায় ইসহাক খান সেখান থেকে পালিয়ে যান। এর পর থেকে মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে তাঁর।’
কামাল মিয়া সেখানে কেন গিয়েছিলেন, জানতে চাইলে তাঁর ভাই মো. কাজল মিয়া বলেন, ‘যদি ভাইরে জীবিত পাইতাম, তাহলে জানতে পারতাম, কেন সে ওখানে গিয়েছিল। সে কাদের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিল, তা-ও জানি না। তার জুয়া খেলার প্রতি আসক্তি ছিল, কিন্তু কোনো দিন চুরি করেছে শুনিনি।’ চুরির অপবাদ দিয়ে ভাইকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাতভর নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার সর্বোচ্চ বিচার চান কাজল।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রউফের বক্তব্য জানতে আজ সোমবার দিনভর তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি। অভিযুক্ত ইসহাকের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. দুলাল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি ওই বাড়ি থেকে গাড়ির মোটর-যন্ত্রাংশ চুরি হয়। গত শনিবার গভীর রাতে দুজনকে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি করতে দেখে স্থানীয় লোকজন ভেবেছিলেন, তাঁরা আবার চুরি করতে এসেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আটক কামাল মিয়াকে পিটুনি দেন তাঁরা। সেখানেই পরদিন দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।
কামাল মিয়ার স্ত্রী শেফালী আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী কেন এবং কার সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন জানি না, তবে তিনি চুরি করতে সেখানে যাননি, এটা আমি নিশ্চিত। আর চুরি করতে গেলেই কি একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? তাঁকে চিকিৎসাটুকু পর্যন্ত দিলেন না তাঁরা। আমার দুই ছেলেকে যাঁরা এতিম করেছে, তাঁদের শাস্তি চাই আমি।’
মনোহরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় মো. হারুন অর রশিদ (৪০) নামের একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে গতকাল বিকেলেই নরসিংদী আদালতে পাঠানো হয়েছে। অপর দুই আসামিসহ জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।