এসএসসি পরীক্ষা শেষের আনন্দে রঙিন হয়ে ওঠা দুই বন্ধুর জীবন মুছে গেল সড়কে

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শাওন হাসান ও জাকির হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

এসএসসি পরীক্ষা প্রায় শেষ। মাত্র একটা ব্যবহারিক পরীক্ষা বাকি। সেই আনন্দে জীবনটা যেন রঙিন হয়ে উঠেছিল তিন বন্ধুর। এক বন্ধুর মোটরসাইকেলে সারা দিন ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে। বিকেলে সবাই মিলে গান করার জন্য আরেকজন কিনেছে নতুন গিটার। আরও কত কী যে পরিকল্পনা চলছিল তাদের!

তবে সেসব পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হলো না। সড়ক দুর্ঘটনা মুছে দিয়েছে তাদের রঙিন জীবন। এখন শুধু প্রিয়জনদের মুঠোফোনের গ্যালারিতে পড়ে আছে তাদের ছবি। ঘরজুড়ে পড়ে আছে ব্যবহারের জিনিসিপত্র।

গতকাল রোববার দুপুরে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা মহাসড়কের বেলতলী এলাকায় বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই এসএসসি পরীক্ষার্থী জাকির হোসেন ওরফে শুভ এবং শাওন হাসান ওরফে সুমিত। একই দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছে অপর বন্ধু নাজমুল হাসান।

তিন বন্ধুর বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায়। কাশিগঞ্জ বাজারের পাশে অবস্থিত ক্রিয়েশান মডেল স্কুল থেকে এবার তারা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল। নাগুয়া গ্রামে বাড়ি নিহত জাকিরের। কাশিগঞ্জ গ্রামে নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত শাওন হাসান। আর আহত নাজমুলের বাড়ি কামারিয়া গ্রামে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার পর কাশিগঞ্জ বাজার ও আশপাশের মানুষের মধ্যে যেন শোকের ছায়া।

জাকিরের ফুফু রাজিয়া খাতুনের আহাজারি। আজ সোমবার সকালে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার নাগুয়া গ্রামে

আজ সোমবার সকাল ৯টায় নাগুয়া গ্রামে জাকিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। গতকাল রাত ১০টায় জাকিরের দাফন হয়ে গেছে। তবু গ্রামের মানুষ আসছে বাড়িতে। এর মধ্যে চোখে পড়ে, জাকিরের ফুফু রাজিয়া খাতুন বিলাপ করছেন। বারবার বলছিলেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন ছিল গায়ক হবে। বিদেশে গিয়ে চাকরি করবে। চাকরির প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমাকে দামি মোবাইল ফোন কিনে দিবে।’

রাজিয়াকে ঘিরে ছিলেন প্রতিবেশী নারীরা। তাঁদের চোখ ছলছল করছিল। জাকিরের মা জেসমিনা আরার চোখে তখন পানি নেই। তিনি স্থির হয়ে বসে আছেন ঘরে। প্রতিবেশীরা জানান, জাকিরের বাবা আবু সাঈদ গেছেন শাওনের জানাজায়। গতকাল সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাওন মারা যায়। আজ সকাল ৯টায় কাশিগঞ্জ বাজারে তার জানাজা হয়।

শাওনের বাবা সাইফুল ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার বিরিশিরিতে। জানাজার পর তার লাশ সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শাওনের নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে কয়েকজন নারী। অন্যরা লাশ নিয়ে বিরিশিরি যাচ্ছেন। শাওনের খালা শিল্পী আক্তার বলেন, ‘আমার ভাগনে দেখতে খুব সুন্দর ছিল। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ত। তার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। আজ সোমবার তাঁর এসএসসির শেষ একটা ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। কিন্তু পরীক্ষা আর শেষ হলো না।’

শাওনের জানানায় অংশ নেন তারাকান্দা উপজেলার বিসকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাকির আহমেদ। তিনি জানান, আহত নাজমুল হাসান ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ সকাল ১০টায় তার একটি অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা।

শাওনের জানাজা শেষে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছিল বাড়ির সামনে। ওই সময় কয়েকজনে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা অভিযোগ করেন, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কে প্রতিদিন হাজারো বালুর ট্রাক চলাচল করে। ওই সব ট্রাকের কারণে সড়কটি ভেঙে যায়। এতে সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে।