অবাধে পরিযায়ী পাখি হত্যা

একটি চক্র ভোলার বিভিন্ন চর ও নদ–নদীতে পাখি ধরে হত্যার পর বা জীবিত বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর মধ্যে বিশ্বের অনেক সংকটাপন্ন পাখিও রয়েছে।

পরিযায়ী পাখিরা চরে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। সম্প্রতি ভোলার সদর উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর চর হাসিনা এলাকায়

ভোলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিবছর শীত মৌসুমে প্রচুরসংখ্যক পরিযায়ী পাখি আসে। এখানে নদ–নদীতে জেগে ওঠা নতুন নতুন চরে ঘুরে বেড়ায় এবং মাছ শিকার করে খায় এসব পাখি। এসব পাখি ফাঁদ পেতে ধরা হয় এবং বিষটোপ ও বন্দুক দিয়ে হত্যা করা হয়। একটি চক্র এসব পাখি ধরে ও হত্যা করে রেঁস্তোরাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে। আইন করে নিষিদ্ধ করা হলেও ভোলায় অবাধে পাখি নিধন চলছে।

পাখি শিকারি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত  অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকে ভোলার চরাঞ্চলে সাইবেরিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে। জানুয়ারি মাসে আসা শেষ হয়। আবার ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ফিরে যেতে শুরু করে।

বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত শতাধিক শিকারি পরিযায়ী পাখি নিধন করেন। শিকারিদের মধ্যে ২৫-৩০ জন পেশাদার, যাঁরা বিষটোপ ও জাল দিয়ে পাখি শিকার করেন। বাকিরা শৌখিন শিকারি।  তাঁরা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করেন। তাঁদের বাড়ি ভোলা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায়। অনেকে ঢাকা ও বরিশাল থেকেও পাখি নিধন করতে ভোলা আসেন।

পাখি শিকারিরা নাম প্রকাশ না করা শর্তে আরও জানান, শিকারিরা গড়ে প্রতিদিন ভোলার চরাঞ্চল থেকে প্রায় ৪০০ পাখি শিকার করেন। একটি পাখি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা বিক্রি হয়। সেই হিসাবে ২ মাসে ২৪ হাজার পাখি হত্যা করা হয়। প্রতিবছর এসব পাখি এক কোটির বেশি টাকায় বিক্রি করেন শিকারিরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলার সদর উপজেলার ভোলার চর, কাচিয়া মাঝের চর, গাজিপুরার চর; দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, মধুপুর, চরমুন্সি, মেদুয়া ইউনিয়নের চর নেয়ামতপুর, ভবানীপুর ইউনিয়ন চর হাজারি, হাজিপুরের চর; তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহিরুদ্দিন, চর মোজাম্মেল, বাসনভাঙার চর; মনপুরা উপজেলার কলাতলীর চর, চর ডেম্পিয়া, কাজিরচর, চর নিজাম, দক্ষিণে সাগর মোহনায় চর শাহাজালাল, ঢালচর, চর কুকরি-মুকরি, তেতুলিয়া নদীর মধ্যে টেগরার চর, গঙ্গাপুর, চর হাসিনা, চরচকিমারাসহ ৭৪টি চরে পাখি বিচরণ করছে।

পাখিবিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সহসভপতি সায়েম উল চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারিতে পাখিশুমারি দল ভোলায় আসে। চলতি বছর জলচর পরিযায়ী পাখিশুমারি দল ৫৪ হাজার ১৮০টি পাখি গুনেছে। ২০২২ সালে এই দল ৩৩ হাজার পাখি গণনা করেছিল। তারা চলতি বছরে ভোলার চরগুলোতে সংকটাপন্ন ১৮ হাজার ৩০০টির মতো গাঙচিল ও সহস্রাধিক বিপন্ন দেশি গাঙচষা পাখি দেখেছে।

কয়েকজন কৃষক ও জেলে বলেন, চরে প্রতিদিন শত শত বালিহাঁস, সিঁথিহাঁস, চখাচখি আসে। শিকারিরা প্রতিদিন এসব হাঁস ও পাখি মেরে নিয়ে যান। চরাঞ্চল ও শহর থেকে আসা অনেক শৌখিন শিকারি ছইওয়ালা নৌকায় এসে বন্দুক দিয়ে পাখি নিধন করছেন। কিন্তু জেলে ও কৃষকেরা প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী ও বন বিভাগকে এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখেননি।

তবে পাখি নিধন বন্ধে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক  তৌফিক ই-লাহী চৌধুরী বলেন, পরিযায়ী পাখি নিধন বন্ধে তিনি মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় দক্ষিণাঞ্চলীয় কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশ এবং ইউএনওদের  চরাঞ্চলে টহল বাড়াতে বলেছেন।

ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগে কর্মরত বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, পরিযায়ী পাখি নিধন বন্ধে তাঁরা প্রতিবছরের মতো এবারও টহল দল গঠন করেছেন।