সাপে কাটলে ওঝা নয়, হাসপাতালেই ভরসা বাড়ছে

সাপে কাটা রোগী জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। সম্প্রতি তোলা
ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজার জেলায় আগে সাপে কাটলে অনেকে ওঝার শরণাপন্ন হতেন। ভরসা করতেন ওঝার ঝাড়ফুঁক ও তাবিজকবচে। তবে পরিস্থিতি এখন অনেক বদলে গেছে। এখন মানুষ বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসায় ভরসা রাখছেন। সাপে কাটার পর আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গত সাত মাসে মৌলভীবাজার জেলায় ১৫৬ জন সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দুজনকে দিতে হয়েছে ‘অ্যান্টি ভেনম’। অন্যদের প্রাথমিক ও সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার হাওর-বাঁওড়, বনজঙ্গল ও চা-বাগানঅধ্যুষিত। একসময় গভীর বনজঙ্গলের দিকে মানুষের আনাগোনা ও বসতি কম ছিল। সাপে কাটার ঘটনা কম ছিল। হঠাৎ দু–একজনকে সাপে কেটেছে শোনা গেছে। তখন রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা হতো। এসব ক্ষেত্রে বিষধর সাপের ছোবলে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই মারা গেছেন। তারপরও মানুষ ঝাড়ফুঁকেই ভরসা রেখেছেন। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসাসেবাও এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না। সাপে কাটা রোগীর যে হাসপাতালে চিকিৎসা হয়, এই ধারণাও অনেকের ছিল না। অনেকেই মনে করতেন ওঝা দিয়ে শরীর থেকে সাপের বিষ নামানোই রোগীকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলেছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। বর্তমানে কাউকে সাপে কাটলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সঠিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠছে।

মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালসহ ৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাপে কাটা রোগীকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য অ্যান্টি ভেনম মজুত আছে। এ ছাড়া সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসা দিতে আছেন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতি মাসের প্রথম বুধবার অনলাইনে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী এলে চিকিৎসার মুহূর্তে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে সাপের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা যুক্ত হয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলায় ১৫৬ জন সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। এই রোগীকে গোখরা সাপে কেটেছিল। রোগীর পরিবারের সদস্যদের অসহযোগিতায় রোগীকে অ্যান্টি ভেনম দেওয়া যায়নি। সাপে কাটা রোগীর মধ্যে দুজনকে অ্যান্টি ভেনম দিতে হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক ও সাধারণ চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ৩ জন, রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬, কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৩, বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩০, কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯, শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫৩ ও জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩২ জন সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সাপে কাটার ঘটনা বেশি।

সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

গত বছর মৌলভীবাজার জেলায় সাপে কাটা ৭২ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকিও থাকে। অ্যান্টি ভেনম দেওয়া হলে অনেক রোগীর অ্যালার্জিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। অনেক সময় রোগীর আত্মীয়স্বজন এটাকে ‘ভুল চিকিৎসা’ হিসেবে প্রচার করেন। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তখন সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ দ্রুত হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়, সহযোগিতা করে। এতে চিকিৎসকেরা আগের থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারেন।

জেলা সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর বন্যার পর জেলায় সাপে কাটার বিষয়টি নজরে পড়ে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সব উপজেলায় সভা করে সাপে কাটার চিকিৎসাকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে ও রাতের বেলা বের হলে সঙ্গে আলো রাখতে বলা হচ্ছে। সাপ আক্রান্ত না হলে কামড় দেয় না। তাই অযথা ভয় না পেয়ে সাপে কাটলে ঝাড়ফুঁক না দিয়ে দ্রুত উপজেলা অথবা জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আগে সাপে কাটলে মানুষ ওঝার কাছে যেত, ঝাড়ফুঁক করাত। এখন মানুষ সচেতন হয়েছে। হাসপাতালে চলে আসে। চিকিৎসা কর্মকর্তারাও প্রশিক্ষিত, আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরাও কাজ করছেন।
সমরজিৎ সিংহ, চিকিৎসক

২৭ জুলাই জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফেসবুক পেজে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়, যা মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জেলার জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। সাপে কাটার পর ১৯ জুলাই গোয়ালবাড়ির আশরাফ (১২), ২২ জুলাই হোসেনাবাদের জেনী বেগম (৩৫), ২৫ জুলাই কাসেমনগরের আখলিমা বেগম (৩৩) ও ২৬ জুলাই সোনারূপার অমরজিৎ (১০) ও পূর্ব বটুলী এলাকার বাসিন্দা কাকলী (১৮) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। কাকলী ছাড়া সবাই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। ওই ফেসবুক পোস্টে সবাইকে সচেতন হয়ে সাপে কাটলে দেরি না করে হাসপাতালে আসতে এবং সঠিক চিকিৎসা নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।

তবে ৬ আগস্ট জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক সমরজিৎ সিংহ প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসাধীন কাকলীও চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘বইপত্র পড়ে, প্রশিক্ষণ নিয়ে যতটুকু জেনেছি, কিছু বিষধর সাপ আছে, সব সাপই বিষধর নয়। আবার বিষধর সাপ ব্যাঙ বা কোনো কিছু খাওয়ার পর কামড় দিলে তেমন বিষ ছড়ায় না। এ ছাড়া অনেক সময় কামড়ের হালকা ছাপ পড়ে। তারপরও ‘অ্যান্টি ভেনম’ দেওয়া লাগলে আমাদের প্রস্তুতি আছে।’

চিকিৎসক সমরজিৎ সিংহ আরও বলেন, আগে সাপে কাটলে মানুষ ওঝার কাছে যেত, ঝাড়ফুঁক করাত। এখন মানুষ সচেতন হয়েছে। হাসপাতালে চলে আসে। চিকিৎসা কর্মকর্তারাও প্রশিক্ষিত, আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরাও কাজ করছেন।