বাতাসে অনুভূত হচ্ছে কনকনে শীত। সেই শীত উপেক্ষা করে হাতে হাতে মাটি সরানোর কাজ করছিলেন সাত শ্রমজীবী নারী। কারও গায়েই শীত নিবারণের পোশাক নেই। সুতি কাপড়ের ওড়নায় সবার শরীর জড়িয়ে রাখা। মাটির দলা হাতে হাতে সড়কের ঢালে স্তূপ করে রাখছিলেন তাঁরা। আজ সোমবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন হায়াতখালী গ্রামের কয়রা নদীর চরে এমন চিত্র দেখা যায়।
এগিয়ে গিয়ে শীত কেমন—জানতে চাইলে আমেনা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘শীত শুধু আমাগের গায়েই লাগে, পেটে লাগে না।’ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মাটির চাপ রাখতে রাখতে সাবিনা খাতুন বললেন, ‘একদিন কাজে না বের হইলে পেট চালানো মুশকিল। নিজেরা খাই বা না খাই, ছাওয়াল-মাইয়েগের জন্যি তো দুই বেলা খাবার জোগাড় করতি হবে। শীতের কষ্ট গায়ে সইলেও পেটে সয় না।’
সপ্তাহ ধরে সুন্দরবন উপকূলে জেঁকে বসেছে শীত। রক্ত হিম করা কনকনে ঠান্ডা বাতাস সুন্দরবনসংলগ্ন কপোতাক্ষ, শাকবাড়ীয়া ও কয়রা নদীপারের শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের জন্য বয়ে এনেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর নারী-পুরুষের জীবিকার প্রধান উৎস নদীতে জাল টেনে চিংড়ির পোনা আহরণ করা।
আজ সকালে কয়রা নদীতে দেখা গেল, অনেক নারী-পুরুষ পিঠে দড়ি বেঁধে জাল টানছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিন ও রাতের জোয়ারে দুবার পোনা ধরেন তাঁরা। সপ্তাহ ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলায় রাতের জোয়ারে কেউ বের হতে পারছেন না। তবে দিনের বেলা যতক্ষণ পারা যায়, পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন তাঁরা।
কয়রা নদীর তীর ধরে একটু সামনে এগোলে দেখা যায়, নদীর চরে সারি সারি ঘর। স্থানীয় লোকজন জানালেন, ‘এটা গুচ্ছগ্রাম, বিভিন্ন দুর্যোগে গৃহহারা মানুষের আবাসস্থল।’
গুচ্ছগ্রাম ছাড়াও নদীর বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়িঘর তুলে বসবাস করছেন বহু মানুষ। শীতে তাঁদের কষ্ট অনেক বেশি। এমনই একজন মুনসুর আলী গাজী। নদীভাঙনে ভিটামাটি হারানোর পর পরিবার নিয়ে শাকবাড়ীয়া নদীর বেড়িবাঁধের ঢালে দুটি খুপরিঘরে বাস করছেন।
গুচ্ছগ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কাঁথা জড়িয়ে, ওড়না জড়িয়ে বা পুরোনো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। আর রাতের বেলা ত্রাণের কম্বলই ভরসা। গুচ্ছগ্রামে নিজ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাতেমা খাতুন নামের একজন। তিনি জানালেন, গত বছর শীতে কম্বল পেয়েছিলেন তাঁরা। সেই কম্বল মুড়িয়েই শীত নিবারণ করার চেষ্টা করেন। তবে এখন যে শীত, সেই কম্বলে শীত মানে না।
রাতে শীতের প্রকোপে ঘুমাতেও পারেননি ফাতেমা। বললেন, বরফের মতো শীত পড়েছে। কম্বল গায়ে দিয়েও পুরো শরীর জমে যাচ্ছে। ওপরের চেয়ে মাটি থেকে উঠে আসা ঠান্ডার কারণে ঘুমানো যায় না। রোদ উঠলে একটু আরাম হয়।
গুচ্ছগ্রাম ছাড়াও নদীর বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়িঘর তুলে বসবাস করছেন বহু মানুষ। শীতে তাঁদের কষ্ট অনেক বেশি। এমনই একজন মুনসুর আলী গাজী। নদীভাঙনে ভিটামাটি হারানোর পর পরিবার নিয়ে শাকবাড়ীয়া নদীর বেড়িবাঁধের ঢালে দুটি খুপরিঘরে বাস করছেন। তিনি বলেন, ‘দিনরাত নদীতে পোনা ধরে যা পাই, তা দিয়ে খাবার টাকাই জোগাড় হয় না। এ অবস্থায় শীতের কাপড় কেনা হয়ে ওঠে না। এখন তো আরও সমস্যা। দাম বাইড়ে যাওয়ায় চাল-ডাল কিনতিই সব টাকা শেষ হয়ে যায়।’
শীত শুধু আমাগের গায়েই লাগে, পেটে লাগে না।আমেনা বেগম, শ্রমজীবী নারী, কয়রা
সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বাঁধের ওপর বসবাসকারী হতদরিদ্র মানুষ জোয়ারে ভেসে আসা সুন্দরবনের গাছের পাতা কুড়াতে ব্যস্ত। তাঁরা জানালেন, রান্নার পাশাপাশি রাতে ও সকালে শুকনা পাতা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করা হয়।
কাটকাট গ্রামের বৃদ্ধা মজিদা খাতুন বললেন, ‘এবার অনেক আগের তে শীত আরাম্ভ হয়েচে। এমনিতে শীতে কাবু হইয়ে গিছি। তার ওপর নদীর ঠান্ডা বাতাস হু-হু করি বেড়ার ফাঁক দে ঘরে ঢোকে, তখন ছেঁড়া খ্যাতা গায়ে দি কোনো রকমে দলা হয়ে থাকি।’
একই গ্রামের বৃদ্ধা রোমেসা বেগম বলেন, ‘ছেলেপুলেরা মাঝেমধ্যি পাতা পোড়ায়ে আগুন জ্বালায়। তখন এট্টু হাত-পা গরম করতি পারি।’
স্থানীয় বড়বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল বাসার বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকাগুলোয় অভাবী মানুষের বসবাস বেশি। দুর্যোগে নিঃস্ব হয়ে শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। গরম কাপড়ের অভাব, এমনকি পরনের কাপড়েরও অভাব তাঁদের। প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারিভাবে এসব গ্রামে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। কেনার সামর্থ্য না থাকায় বেশির ভাগ পরিবারের শীত কাটে ত্রাণের বস্ত্রে।