সুনামগঞ্জের ১৯ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে ২০ বছর আগে প্রায় ৩ হাজার গাছ রোপণ করা হয়েছিল। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় স্থানীয় মানুষকে নিয়ে এগুলো রোপণ করা হয়। এখন সড়কের দুই পাশে সারি সারি গাছগুলো বেশ বড় হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই এসব গাছ কাটার আয়োজন চলছে। বন বিভাগ গাছ কাটার জন্য দরপত্র ডেকেছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’ (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক ও ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’র (ধরা) আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য আবদুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে।
আপনি বলছিলেন সামাজিক বনায়ন বিধির পরিবর্তন চান, সেটা কী রকম?
আবদুল করিম চৌধুরী: সামাজিক বনায়ন বিধির দোহাই দিয়েই তো এসব গাছ কাটা হয়। যে সড়কের কথা বলছেন, সেখানে সব গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই সব গাছ কাটা যাবে না। নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে কিছু গাছ স্থায়ীভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সড়কের দুই পাশের সব জায়গা নিরবচ্ছিন্নভাবে সামাজিক বনায়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া পরিবর্তন করা উচিত। সামাজিক বনায়নের গাছ মেয়াদপূর্ণ হলেই কেটে ফেলা হয়। যদিও পরে আবার গাছ লাগানো হয়। কিন্তু এত এত গাছ কাটার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা সদ্য লাগানো চারাগাছ পূরণ করতে পারে না। আবার এই কর্মসূচিতে সড়কের পাশে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘এলিয়েন’ গাছ লাগানো হয়। এসব গাছ আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য খুব একটা উপকারী নয়। এসব গাছে দেশি কোনো পাখি পর্যন্ত বসে না। তাই দেশীয় ঔষধি, বনজ ও ফলদ গাছ লাগাতে হবে। আবার গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। গাছ লাগানোর কয়েক বছর পরই যদি আবার সেই গাছ কাটতে হয়, তাহলে এভাবে গাছ না লাগানোই ভালো।
এত এত গাছ কাটার বিষয়ে একজন পরিবেশকর্মী হিসেবে কী বলবেন?
আবদুল করিম চৌধুরী: এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। কিন্তু সামাজিক বনায়নে যে গাছ লাগানো হয়, তা কেটে ফেলার উদ্দেশ্যেই লাগানো হয়। অথচ নামকরণ করা হয়েছে বনায়ন! ‘বন’ হলে বন্য প্রাণীর কথা মাথায় রাখতে হয়। আসলে সড়কের পাশে বন বিভাগ যা করে, তা হলো সামাজিক ব্যবসা। সেই ব্যবসার পণ্য হলো দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষ। ব্যবসায় মুনাফাই আসল। এখানে গাছে বাসা বানানো পাখির কথা ভাবা হয় না। পোকামাকড়, কীটপতঙ্গের কথা চিন্তা করা হয় না। একটি গাছকে কেন্দ্র করে ২০ থেকে ৩০ বছরে যে ইকো-সিস্টেম গড়ে ওঠে, তা বন কর্মকর্তাদের নজর এড়িয়ে যায়। একটি গাছ কাটা মানে এই সবকিছুই শেষ করে দেওয়া।
তাহলে কীভাবে গাছগুলো রক্ষা করা যায়?
আবদুল করিম চৌধুরী: সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় উপকারভোগীদের সঙ্গে একটা চুক্তি হয়। এখন ওই সব উপকারভোগীকে নিয়ে বসা যেতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে সব গাছ যাতে না কাটা পড়ে, সেটি তাঁদের বোঝাতে হবে। যেগুলো কাটতেই হবে, সেগুলো ছাড়া অন্যগুলো রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে যেসব গাছ কাটতেই হবে, সেগুলোর একটা মূল্য নির্ধারণ করে সরকারের পক্ষ থেকে সেই অর্থ উপকারভোগীদের দেওয়া যেতে পারে।
স্থানীয় জনগণ কী ভূমিকা রাখতে পারেন?
আবদুল করিম চৌধুরী: সড়কের পাশের গাছগুলো রোপণ, পরিচর্যায় তাঁদের একটা ভূমিকা থাকে। গাছগুলো তো তাঁদের উপকারে লাগে বেশি। যদিও অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবেই এসব গাছ বেড়ে ওঠে বেশি। স্থানীয় লোকজন আন্তরিক না হলে এসব গাছ রক্ষা করা কঠিন। প্রকৃতি, পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি এসব গাছ থেকে স্থানীয় লোকজন নানাভাবে উপকৃত হন। এ জন্য আমরা বারবার বলি দেশি ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর জন্য। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রে সেটা হয়। তাই গাছ লাগানোর জন্য স্থানীয় লোকজনকে বিষয়টি জোড় দিয়ে বলতে হবে। সড়কের পাশে একটি ফলের গাছ থাকলে পথচারী, এলাকাবাসী সবাই গাছ থেকে ফল পাবেন।
এই তিন হাজার গাছ রক্ষা প্রশাসন কী করতে পারে?
আবদুল করিম চৌধুরী: প্রশাসন চাইলে গাছগুলো রক্ষা করতে পারে। তবে এই সড়কে যে গাছ আছে, তার বেশির ভাগই বিদেশি ও দ্রুত বর্ধনশীল। এখন প্রশাসন বন বিভাগ ও স্থানীয় উপকারভোগীদের নিয়ে বসুক। একটা আলোচনা করে দেশি গাছগুলো যাতে কাটা না হয়, সে ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করুক। এটা উদ্যোগ নিলেই সম্ভব।
সামাজিক বনায়ন সম্পর্কে আপনার আর কোনো পরামর্শ আছে?
আবদুল করিম চৌধুরী: সড়কের পাশে বনায়ন হতে হবে পরিকল্পিতভাবে। দেখা যায়, গাছ লাগানোর কয়েক বছর পরই সড়ক প্রশস্ত করতে গাছ কাটা পড়ে। আবার অনেক সময় যানবাহন ও পথচারী চলাচলে সমস্যা হলেও গাছ কাটতে হয়। তাই একটি সড়কের পাশে গাছ লাগাতে হলে অন্তত ৫০ বছরের কথা মাথায় রাখতে হবে। সড়ক-মহাসড়কে ছায়াদানকারী দেশীয় কিছু গাছ একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগানো উচিত। যা কোনোভাবেই সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের তালিকাভুক্ত হবে না। এসব গাছ শতবর্ষী হবে। বর্তমান বনায়নে কোনো গাছ শতবর্ষী হোক, তা প্রত্যাশাই করা হয় না।