রাস্তার দুই ধারে সারি সারি পেঁপেগাছ। গাছগুলোর উচ্চতা গড়ে ৮ থেকে ১০ ফুট। ফুটানো ছাতার মতো সবুজ পাতাগুলোয় সূর্যের আলো পড়েছে। গাছের ছায়া পড়েছে রাস্তায়। তপ্ত রোদে বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে রাস্তাগুলো। গাছগুলোয় গাঢ় সবুজ রঙের পেঁপে ঝুলে আছে; যেন পথচারীদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে পেঁপেগুলো।
রাস্তার দুই ধারে চার শতাধিক পেঁপেগাছের দেখা মিলবে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। জমিদারনগর থেকে বলরাম বাজার যাওয়ার পথে কাঁচা রাস্তার ধারে এসব পেঁপে চাষ করেছেন গ্রামের কৃষক আলতাফ হোসেন (৪৫)। গাছগুলোর বয়স প্রায় ছয় মাস। এরই মধ্যে ৩০ মণ পেঁপে বিক্রি করেছেন। পাইকারি দরে দাম পেয়েছেন প্রায় ২২ হাজার টাকা।
৭ সেপ্টেম্বর সকালে ডাঙ্গাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পেঁপেগাছের গোড়া পরিষ্কার ও সেচ দেওয়ার কাজ করছেন আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, পেঁপে চাষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার পেঁপে বিক্রি করবেন। ‘গ্রিন লেডি’ জাতের পেঁপের একেকটির ওজন হয় ৩ থেকে ৬ কেজি পর্যন্ত। দেখতে লম্বাকৃতির। তবে নিচের দিকে কিছুটা গোলাকৃতির। দেখতে যেমন সুন্দর, স্বাদও বেশ ভালো। বিক্রি করতে বাজারে যেতে হয় না। পাইকার এসে বাগান থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। পেঁপে বিক্রির টাকা মৃত মায়ের নামে নির্মাণাধীন মাদ্রাসার পেছনে ব্যয় করছেন তিনি।
ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের কৃষক গুলজার রহমানের একমাত্র ছেলে আলতাফ হোসেন। ২০০৬ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষে করেন। সে সময় বীরগঞ্জের এক কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছু টাকা চেয়ে বসে। বিষয়টি আলতাফ তাঁর এক পরিচিত বড় ভাই আবু তাহেরকে (সুপ্রিম সিড কোম্পানিতে কর্মরত) জানান। আলতাফের পৈতৃক ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষের পরামর্শ দেন আবু তাহের। তাঁর কথামতো সে বছর দুই বিঘা জমিতে আলু লাগিয়ে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করেন। আলতাফ বলেন, ‘সেই যে কৃষিকাজে মন দিয়েছি, আর চাকরি খুঁজিনি কোথাও। এখন হাতে টাকা এলেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঘুরে আসি। দেশের ৪০টিরও বেশি জেলা দেখেছি। এবার সপরিবার সৌদি আরব যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।’
কৃষিকাজে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানিতও হয়েছেন কৃষি উদ্যোক্তা আলতাফ হোসেন। ২০১৬ সালে সিটি ব্যাংকের সিটি ফাউন্ডেশন থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন।
২০১৭ সালে দুই একর জমিতে আদা চাষ করেছিলেন আলতাফ। ৫০০ মণ আদা পান। ৪ হাজার টাকা মণ হিসেবে সেবার ২০ লাখ টাকার আদা বিক্রি করেন। বর্তমানে নিজের ১০ বিঘা ও অন্যের ১৫ বিঘা বর্গা নিয়ে মোট ২৫ বিঘা জমিতে পেঁপে ছাড়াও আলু, আদা, শিম, বরবটি, মুলা, বেগুন, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ওলকচু, ধান ও ভুট্টা চাষ করছেন। আলাপকালে পেঁপেবাগান থেকে বাড়িসহ কয়েকটি ফসলের খেতে ঘুরিয়ে দেখালেন আলতাফ।
আলতাফের ঘরের দরজা খুললেই দেড় বিঘা জমিজুড়ে পুকুর চোখে পড়ে। সেই পুকুরে দেশি-বিদেশি মাছের চাষ করছেন। বাড়ির পেছনে বাঁধা ১০টি গরু ও ১২টি ছাগল। আমবাগানও আছে বিঘাখানেক। খেতের মধ্যে দেখা গেল বেগুন, মরিচ, বরবটি, করলা, ওলকচু। বাড়ির চারপাশে ৩৫ প্রজাতিরও বেশি ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ বলে জানালেন আলতাফ। তিনি বলেন, আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও গাজর চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা হচ্ছে। চারজন শ্রমিক নিয়মিত তাঁর খেতে কাজ করেন। মৌসুমে ১২ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। মাসে শুধু সবজি থেকেই তাঁর আয় হয় ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
কৃষিকাজে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানিতও হয়েছেন কৃষি উদ্যোক্তা আলতাফ হোসেন। ২০১৬ সালে সিটি ব্যাংকের সিটি ফাউন্ডেশন থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন। আলতাফ দুই ছেলে–মেয়ের বাবা। মেয়ে মাদ্রাসায় কিতাব বিভাগের শিক্ষার্থী। আর ছেলের বয়স সাত বছর। স্ত্রী স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনিও সহযোগিতা করেন আলতাফকে।
শিক্ষিত ব্যক্তিদের কৃষিকাজে আসা উচিত বলে মনে করেন আলতাফ হোসেন। কৃষিকাজ ও জীবনযাপন বিষয়ে আলতাফ বলেন, ‘সুখ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ভালোই তো আছি। কৃষিকাজ করে পাকা বাড়ি করেছি। রংপুর থেকে দিনাজপুর—কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই জানেন আমার কৃষির কথা। এলাকার মানুষের কাছেও প্রিয় হতে পেরেছি। মসজিদসহ এলাকায় ঘুরে কৃষকদের ফসলে কীটনাশক ব্যবহার কমানোর জন্য আন্দোলনে নেমেছি। আমি বিশ্বাস করতে শিখেছি, সময়, অর্থ ও শ্রম যদি ভালো কাজে ব্যয় করা হয়, তবে একদিন সফলতা আসবেই।’
মৌসুমে ১২ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। মাসে শুধু সবজি থেকেই তাঁর আয় হয় ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।আলতাফ হোসেন, কৃষি উদ্যোক্তা
আলতাফের কৃষিকর্মযজ্ঞ বিষয়ে খানসামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইয়াসমিন আক্তার বলেন, তিনি খুবই ভালো মানের একজন কৃষক। কৃষিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহার করে কীভাবে চাষাবাদ করা যায়, সে জন্য কাজ করছেন। সর্বশেষ পেঁপে চাষেও তিনি সফলতা পেয়েছেন। কৃষি বিভাগ তাঁর কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি কৃষি বিভাগের কাছে পৌঁছে যান। নতুন নতুন ফসল চাষে তাঁর আগ্রহ বেশি। এ জন্য তাঁকে সব সময় সহযোগিতা করা হচ্ছে।