পানির তোড়ে দিনমজুর নিত্য বিশ্বাসের কাঁচা ঘরের মাটি ধসে গেছে। ভেঙে গেছে টিনের বেড়া। রাতে বিষধর সাপের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের। শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ভাটি শাহপুর এলাকায়
পানির তোড়ে দিনমজুর নিত্য বিশ্বাসের কাঁচা ঘরের মাটি ধসে গেছে। ভেঙে গেছে টিনের বেড়া। রাতে বিষধর সাপের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের। শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ভাটি শাহপুর এলাকায়

সাপের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের

টিন ও বাঁশের তৈরি ছোট একটি ঘরে নিত্য বিশ্বাস স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন। ঘরে হাঁটুপানি অবস্থায় পাঁচ দিন কাটে তাঁদের। এখন ঘর থেকে উঠানে নেমেছে পানি। তবে আতঙ্কে কাটেনি। বাতাসে হাওরের বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে ঘরে। ঢেউয়ের তোড়ে ঘরের ভিটা ও বেড়া ধসে গেছে। বিষধর সাপের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের।

নিত্য বিশ্বাসের বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভাটি শাহপুর গ্রামে। শুধু নিত্য বিশ্বাসই নন, দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ভাটি শাহপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

গতকাল শনিবার দুপুরে ভাটি শাহপুরে নিত্য বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই কক্ষের ঘরের মেঝে কর্দমাক্ত। তাতে কাঠের তক্তা বিছিয়ে পরিবারের সদস্যরা চলাচল করছেন। ঘরের ভিটার বেশ কিছু মাটি ধসে গেছে। ভেঙে গেছে টিনের বেড়ার নিচের অংশ। সেখানে আলাপকালে নিত্য বিশ্বাসের স্ত্রী বীণা রানী বিশ্বাস বললেন, ‘পানি (বন্যা) আইছে বাদ থাকি আমরার কষ্টর সীমা নাই। পাঁচ দিন ঘরো পানি আছিল। এর মাঝেও কষ্ট করি থাকছি। অখন মারের ঢেউয়ে। ঢেউর মাইরে ঘরদোর বাঁচানিই দায় অই গেছে। রাইতে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়া সাপ ঢুকে। কিন্তু, আমরা মারি না। সরাইয়া দিলাই, আপনে আপনে যায়গি।’

বন্যার পরপরই মৎস্যজীবী অজিত বিশ্বাস পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। হাওরের পানির ঢেউয়ের তোড়ে তাঁর কাঁচা ঘরের ভিটেমাটি ধসে পড়েছে। ভেঙে গেছে টিনের বেড়া। শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পশ্চিম গোবিন্দপুরে

ভাটি শাহপুরে কাঁচা বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। ঢেউ ঠেকাতে কেউ কেউ বসতঘরের পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে আলাদা বেড়া স্থাপন করেছেন। আবার কেউ কেউ কচুরিপানা স্তূপ করে রেখেছেন। হাওরের পাশ ঘেঁষেই শাহগঞ্জ বাজার। বাজারে যাওয়ার মূল সড়ক এখনো চার থেকে পাঁচ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। বাজারের প্রবেশমুখে উঁচু সেতুর ওপর পলিথিনের ছাউনির নিচে কয়েকটি গরু রাখা। সেখানে গরুকে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা হেলাল মিয়া। তিনি বললেন, ‘গোয়ালঘর থাকি অখনো পানি নামছে না। এর লাগি গরুগুলারে এইখানে আনি রাখছি। আরও গরু ছিল। পানি কিছু কমায় অন্যরা বাড়ি নিয়া গেছি।’

গোখাদ্য নিয়ে এলাকার লোকজন সংকটে পড়েছেন বলে জানালেন হেলাল মিয়া। তিনি বলেন, ‘আওর, জমিন সব জেগাত পানি। গরু-ছাগল খানি কই পাইত। তারার খানি জুটানি বড় একটা সমস্যা।’

বাড়িঘর থেকে পানি না নামায় উঁচু সেতুর ওপর গবাদিপশু বেঁধে রাখা হয়েছে। শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার শাহগঞ্জ বাজার এলাকায়

বাজারে তিন-চারটি দোকান খোলা। মুদিদোকানি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মতছিন আলী বললেন, ‘বাজারে তো মানুষই নাই। থাকলে বেচাকেনা হইত। দোকান খুলি বসছি আরকি। বেচাকেনা একেবারে কম।’

বাজারের পাশের পশ্চিম গোবিন্দপুর গ্রামে চার-পাঁচটি কাঁচা ঘরের ভিটামাটি ধসে গেছে। টিনের বেড়াও ভেঙে পড়েছে। এসব ঘর মানুষশূন্য। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, বন্যা শুরুর পর এসব ঘরের লোকজন নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। হাওরের ঢেউয়ে ঘরগুলোর বেশ ক্ষতি হয়েছে।

জুড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মিজানুর রহমান বলেন, বন্যায় এ পর্যন্ত হাওর এলাকায় প্রায় ৪ হাজার কাঁচা বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। পানি পুরোপুরি নামেনি। পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

ঘর থেকে পানি নেমে গেলেও হাওরের পানির ঢেউয়ের তোড়ে দিনমজুর নিত্য বিশ্বাসের ঘরের ভিটায় ধস নেমেছে। ভেঙে গেছে টিনের বেড়া। শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ভাটি শাহপুর এলাকায়

ভাটি শাহপুর, শাহপুর, দীঘলবাক ও পশ্চিম গোবিন্দপুরের অধিকাংশ বাড়িঘর থেকে এখনো পানি নামেনি। নানা কাজে লোকজন নৌকায় চলাচল করছেন। ভাড়ায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালান শাহপুরের প্রজয় বিশ্বাস। জরুরি কোনো প্রয়োজন, হাওরের মাছ ও ভারী মালামাল পরিবহনে অনেকে তাঁর নৌকা ভাড়া নেন। প্রজয় বলেন, ‘এলাকার সব বাড়িতেই এক-দুইটা নৌকা আছে। বাজার-হাটে যাওয়া লাগে। অসুস্থ মানুষরে ডাক্তরের কাছে নেওয়া লাগে। নৌকা ছাড়া উপায় নাই।’  

স্থানীয় মানিকসিংহ বাজারে মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে পশ্চিম দিকে শাহগঞ্জ বাজারের সড়ক গেছে। সড়কের কিছু স্থানে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে এখনো কয়েকটি সেতু, কালভার্ট, দীঘলবাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ডুবে আছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা কার্যালয়ের প্রকৌশলী সুদর্শন সরকার বলেছেন, বন্যায় উপজেলার প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ হিসাব এখনো চূড়ান্ত নয়। বন্যার পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আবার নিরূপণ করা হবে।