রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজন। আজ রোববার দুপুর ২টা থেকে উপজেলার বরাতি এলাকায় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে তাঁরা এই কর্মসূচি পালন করেন।
সন্ধ্যা ৬ টার দিকে তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানার আশ্বাসে আন্দোলনকারীরা সড়ক ছেড়ে দেয়।
ইউএনও বলেন, ‘ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা আমাকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। আমি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি প্রধান শিক্ষককে। এর মধ্যে আজ শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা মহাসড়ক অবরোধ করে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলি। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিয়ে বিদ্যালয় মাঠে বসবো।’
এর আগে অবরোধকারীরা দাবি করেন, ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মফিজাল রহমান মিলে প্রভাব খাটিয়ে একই পরিবারের সাতজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। এতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগও দিয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘ভাই, নিজের জমি-জায়গা দিয়ে অনেক কষ্টে এই বিদ্যালয় আমার ভাইসহ প্রতিষ্ঠা করেছি। নিয়ম অনুযায়ী, আমার ভাই মফিজাল রহমান সভাপতি হয়ে আসছেন। বিধি মোতাবেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একটি মহল প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্টের জন্য শিক্ষার্থীদের দিয়ে এসব করাচ্ছে।’ তবে অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি মফিজাল রহমানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের বড়গোলা এলাকায় ঘনিরাপুর বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান আলিয়ার রহমান। এরপর তিনি তাঁর বড় ভাই মফিজাল রহমানকে কৌশলে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি করেন। বর্তমানে বিদ্যালয়টির শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ২১ জন। এর মধ্যে সাতজনই প্রধান শিক্ষকের স্বজন।
বিদ্যালয়টির পাশের গ্রামের বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো নির্বাচন করা হয়নি। প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় সভাপতি দুই ভাই মিলে তাঁদের পরিবারের সাতজনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি দুই ভাই মিলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাঁদের ভাই, ভাতিজা ও ভাতিজার স্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছেন। ২০০০ সালে প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী আলেয়া বেগম সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৪ সালে ভাতিজা আজম আলী, ২০১৬ সালে ভাতিজার স্ত্রী মোরশেদা বেগমকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর ২০২২ সালে আরেক ভাতিজা আজমির সরকারকে পিয়ন ও ভাতিজার স্ত্রীকে মালি পদে নিয়োগ দেন তাঁরা। ২০২৩ সালে প্রধান শিক্ষক তাঁর আরেক ভাতিজাকে ঝাড়ুদার পদে নিয়োগ দেন।
বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলে, ‘প্রধান শিক্ষক স্যারের পরিবারে সবাই এখানে চাকরি করেন। তাঁদের খুব দাপট। নানা অজুহাতে আমাদের কাছ থেকে বেশি করে টাকা নেন। ঠিকমতো স্কুলে আসেন না, ক্লাস নেন না। এসব বিষয়ে ইউএনও স্যারকে অভিযোগ দিয়েছি আমরা। এ ঘটনা নিয়ে আলেয়া ম্যাডাম আমাদের হুমকি দিয়েছেন। ক্লাসে অপদস্থ করেছেন। আমরা এমন দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক চাই না। তাই তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সড়কে দাঁড়িয়েছি।’
বড়গোলা এলাকার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নজির উদ্দিন বলেন, ‘এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের বাড়ির সউগ লোকজন নিয়োগ দিয়া থুইছে। কথা-কথায় ছাওয়ার ঘরে কাছোত টাকা চায়। হামরা কিছু কইলে স্কুল থাকি ছাওয়াগুলাক টিসি দিবার হুমকি দেয়। ওমার ভয়ে অন্য শিক্ষকেরাও কিছু কবার পায় না। হামরা এই শিক্ষকের পদত্যাগ চাই।’ আরেক অভিভাবক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ওরা সাতজন হেভি শক্তিশালী। অন্য শিক্ষকেরাও ওমার ভয়ে কিছু কবার পায় না। দেশোত কি আর শিক্ষিত লোক আছিল না, যে প্রধান শিক্ষকের ভাই, ভাতিজা, বউ দিয়া স্কুল ভর্তি করোছে। স্কুলটা প্রধান শিক্ষক লুটপাট করি খাওছে।’
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী ইউএনওর কাছে ৬ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন প্রধান শিক্ষক, তাঁর স্ত্রী ও স্বজনেরা। গত বৃহস্পতিবার প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী সহকারী প্রধান শিক্ষক আলেয়া বেগম বিদ্যালয়ের প্রতিটি কক্ষে গিয়ে ইউএনওর কাছে অভিযোগ করার কারণ জানতে চান। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থীদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে প্রধান শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেন।
খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ইউএনও রুবেল রানা ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরানোর চেষ্টা করেন। ইউএনও রুবেল রানা বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরই ৮ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শাণোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।