কুড়িগ্রামের চিলমারী নদী বন্দর
কুড়িগ্রামের চিলমারী নদী বন্দর

শীতে ভ্রমণের সুন্দর গন্তব্য হতে পারে কুড়িগ্রাম

‘বন্ধুধন, আরে ও সোনা বন্ধুধন, তোমরা আইসেন বন্ধু হামার কুড়িগ্রাম। তোমাক মন ভরে শোনামো ভাওয়াইয়া গান।’ গীতিকার আবদুল খালেক ফারুকের গানের নিমন্ত্রণপত্র নিয়ে ঘুরতে যেতে পারেন উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম। আয়তনে ছোট জেলা হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তের এই জেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মভূমির এই অঞ্চলের মানুষ তাঁদের সুখ–দুঃখের কথা ভাওয়াইয়া গানের সুরে সুরে প্রকাশ করেন।

প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। এই সময় কুড়িগ্রাম হিমালয়ের সতেজ স্নিগ্ধতায় ডুবে থাকে। সোনালি ধানের শিষের ডগায় জমানো শিশিরবিন্দু উপভোগ করতে করতে ঘুরতে পারেন উলিপুর মুন্সিবাড়ি জমিদারবাড়ি; মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের সংগ্রহশালা উত্তরবঙ্গ জাদুঘর, বাঁশজানি জামে মসজিদ, ঐতিহাসিক চিলমারী নদীবন্দর।

উলিপুর মুন্সিবাড়ি জমিদারবাড়ি

জেলা শহর থেকে উলিপুর উপজেলার দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে দুই কিলোমিটার পথ গেলেই ধরণীবাড়ি ইউনিয়নে উলিপুর মুন্সিবাড়ি জমিদারবাড়ি। এই জমিদারবাড়ির মালিক ছিলেন বিনোদী লাল নামের একজন মুন্সি বা মুনসেফ। বিনোদী লাল মুন্সির পূর্বপুরুষের কেউ জমিদার ছিলেন না। কাশিম বাজারের সপ্তম জমিদার কৃষ্ণনাথ নন্দীর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মহারানি স্বর্ণময়ী দেবীর অধীনে হিসাবরক্ষকের কাজ করতেন বিনোদী লাল মুন্সি। আঠারো শতকে বিনোদী লালের পালক ছেলে শ্রী ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির তত্ত্বাবধানে চমৎকার স্থাপত্যের এই বাড়ি নির্মিত হয়। মুন্সিবাড়ির মূল ভবনে আছে শয়নকক্ষ, ডাইনিং হল, রান্নাঘর, অঙ্কনকক্ষ, বিশ্রামঘর ও অতিথিশালা।

এ ছাড়া মূল বাড়ির পেছনের দিকে একটি শিবমন্দির, উন্মুক্ত দোলমঞ্চ, তুলসীবেদি, নাটমন্দির, দুর্গামন্দির, খোলা কূপসহ স্নানাগার রয়েছে। অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে আছে এগুলো। জমিদারবাড়ির সামনের দিকে একটি হাতিশালা, মূল ফটকের পাশে আছে কাঁঠালিচাপা ফুলের গাছ এবং শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুন্সি লালের বংশধরেরা কলকাতায় চলে গেলে বেশ কয়েকবার বাড়ির মালিকানা বদল হয়। বর্তমানে উলিপুর মুন্সিবাড়িটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে নিবন্ধিত আছে।

উত্তরবঙ্গ জাদুঘর

নতুন শহর কুড়িগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে ওঠা ব্যতিক্রমধর্মী এক জাদুঘরের নাম ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’। ২০১২ সালে এস এম আব্রাহাম লিংকন জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হাজারো ইতিহাস ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের সংগ্রহশালা জাদুঘরটি মূলত আইনজীবী আব্রাহাম লিংকন ও অধ্যাপক নাজমুন্নাহার দম্পতির বসতবাড়ি। এটি রাতে থাকার ঘর ও দিনে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এই জাদুঘরের নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ চলমান।

কুড়িগ্রাম জেলায় প্রতিষ্ঠিত হলেও উত্তরবঙ্গ জাদুঘর বৃহত্তর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ আঞ্চলিক–সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সংগ্রহশালা হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। হাতিয়া গণহত্যাসহ অনেকগুলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও ইতিহাস এই জাদুঘরে রয়েছে। এই জাদুঘরের সংগ্রহশালাগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগে আছে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন এবং অন্য ভাগে আছে স্থানীয় ইতিহাস। এই জাদুঘরে গেলে দেখা মিলবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গুলি ও গ্রেনেড বাক্স, মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য দলিল–দস্তাবেজ ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ধাতব মুদ্রা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় রৌমারীর রণাঙ্গন থেকে প্রকাশিত হাতে লেখা ‘অগ্রদূত’ পত্রিকার প্রায় সবগুলো সংখ্যা সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। সপ্তাহের শনিবার সারা দিন দর্শনার্থীদের জন্য এই জাদুঘর খোলা থাকলেও আগে খবর দিয়ে গেলে প্রতিদিনই জাদুঘর পরিদর্শন করা যায়।

বাঁশজানি জামে মসজিদ

কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। সেখান থেকে পাথরডুবী ইউনিয়নের সীমান্তঘেষা গ্রাম বাঁশজানির দূরত্ব আরও ১০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে ভাতৃত্বের এক অসামান্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ বাঁশজানি ঝাকুয়াটারী জামে মসজিদ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ১৮২০ সালে নির্মিত এই মসজিদ বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে পড়ে। মসজিদের উত্তর দিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার ঝাকুয়াটারী গ্রাম এবং দক্ষিণ দিকে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবী ইউনিয়নের বাঁশজানি গ্রাম। গ্রামটি আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার দিয়ে দুই দেশে বিভক্ত হলেও ভাগ হয়নি বাসিন্দাদের সামাজিক বন্ধন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশীর মতোই বসবাস করে আসছেন তাঁরা। এই মসজিদে দুই দেশের মানুষ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এই মসজিদ দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মুসল্লিরা আসেন, নামাজ আদায় করেন।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরণীবাড়ি ইউনিয়নে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উলিপুর মুন্সিবাড়ি। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত

চিলমারী নদীবন্দর

‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে…’, ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া বিখ্যাত গান। ১৯৪৭ সালের আগে সেই চিলমারী নদীবন্দর থেকে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন জায়গায় যেত। দেশ ভাগের পর ঐতিহাসিক ওই বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে দেশের সর্বশেষ ও ৫৩তম নদীবন্দর হিসেবে চিলমারী বন্দর আবার চালু হয়। একসময় এই চিলমারী বন্দরে ছিল জাহাজ ভাঙার কারখানা। কুড়িগ্রাম শহরের শাপলা চত্বর থেকে চিলমারী নদীবন্দরের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। বর্তমানে চিলমারী বন্দরে আর গাড়িয়াল ভাইয়ের হাঁকডাক শোনা যায় না। তবে বন্দর থেকে রৌমারী ব্রহ্মপুত্র নদ পারাপারের জন্য দুটি ফেরি চালু রয়েছে। নদীবন্দর ঘাট থেকে ৩০ মিনিটের নৌপথে শাখাহাতির চর। এই চরে তাঁবুবাস করলে সকালে ব্রহ্মপুত্র নদে সূর্যোদয় ও বিকেলে একই নদে সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়া যায়।

এ ছাড়া নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ জমিদারবাড়ি, রাজারহাট উপজেলার পাঙ্গা রাজবাড়ি, ফুলবাড়ী উপজেলায় নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ি, ভূরুঙ্গামারি উপজেলার সোনাহাট স্থলবন্দর, উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণী ইউনিয়নে বাহারবন্দ পরগনার প্রথম রাজধানীর ধ্বংসস্তূপ এবং উলিপুর উপজেলার কাজীর মসজিদসহ নানা ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখতে পারবেন ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকেরা।