কুমিল্লা নগর থেকে দেবীদ্বার উপজেলার হোসেনপুর গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক–লাগোয়া উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের গ্রামটিতে শনিবার দুপুর ১২টার দিকে প্রবেশ করতেই নীরব মনে হচ্ছিল। চারদিকে শোকের আবহ।
অবশ্য গ্রামটির পরিবেশ এমনটা হওয়ার কারণও রয়েছে। কারণ, এই গ্রামেরই দুই ভাই-বোন একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে একটি বাসের চাপায়। শিশু দুটির মা–বাবার আর কোনো সন্তান নেই। ওই দম্পতির আহাজারিতে ভারী হয়ে আসছিল বাতাস।
গত বৃহস্পতিবার রাতে কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের দেবীদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের ছগুরা এলাকায় বাসচাপায় নিহত হয় জুনায়েদ হোসেন (১২) ও তাঁর ছোট বোন ফাহিমা আক্তার (১০)। বাবা জাহাঙ্গীর আলম সিএনজি অটোরিকশাটি চালাচ্ছিলেন। এ যেন বাবার গাড়িতে চড়ে দুই সন্তানের শেষযাত্রা।
জাহাঙ্গীর আলম হোসেনপুর গ্রামের মান্তু মেম্বার বাড়ির বাসিন্দা। মহাসড়ক–লাগোয়া হলেও তাঁদের বাড়িতে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। চলাচলের একমাত্র পথ ধানখেতের আইল। আজ শনিবার দুপুরে মহাসড়কের বাঁ পাশ দিয়ে অটোরিকশাচালক জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে আসছিল শিশুদের জন্য স্বজনদের আহাজারি। সাংবাদিক এসেছে শুনেই বাড়িতে তাঁদের থাকার টিনের ঘরটি থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসেন নিহত জুনায়েদ ও ফাহিমার মা শেফালি বেগম। ৩০ বছর বয়সী এই গৃহবধূ সন্তানদের জন্য বিলাপ করতে করতে যেন কান্না করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। কথাও বলতে পারছেন না।
বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করার সময় ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে শেফালি বলেন, ‘আমার কিচ্ছু চাই না, আমার বুকের মানিকটিরে ফিরাইয়া দেন। আমার কইলজা ভাইঙ্গা দিসে গো পাষাণ বাস ড্রাইভারে। আমি অহন কী লইয়া থাইক্যাম।’
ঘটনার পর শিশুদের মরদেহ বাড়ির আঙিনায় যেখানে রাখা হয়েছিল, সেই স্থানটি দেখিয়েও কান্না করতে করতে একপর্যায়ে মাটিতেই লুটে পড়েন দুই সন্তান হারানো শেফালি। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বাড়ির অন্য নারীরা। তবে কোনো সান্ত্বনাতেই কান্না থামছে না তাঁর।
বাড়ির বাসিন্দারা জানান, জাহাঙ্গীর ও শেফালি দম্পতির বিয়ে হয়েছিল ২০১২ সালে। বিয়ের প্রথম বছরই তাঁদের প্রথম সন্তান জুনায়েদ হোসেনের জন্ম হয়। এর দুই বছরের মাথায় আসে দ্বিতীয় সন্তান ফাহিমা আক্তার। ৩২ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর আলম স্বল্প আয়ের মানুষ। তাঁরা চেয়েছিলেন দুটি সন্তানকেই মানুষের মতো মানুষ করতে। এ জন্য পরিকল্পনা করে আর কোনো সন্তান নেননি। কিন্তু তাঁদের সেই আদরের দুই ধনই এখন কবরে। জুনায়েদ জাফরগঞ্জের শ্রীপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষার্থী আর ফাহিমা হোসেনপুর নূরানি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে মাদ্রাসা থেকে বাবার অটোরিকশায় চড়ে নানার বাড়ি একই উপজেলার অলুয়া গ্রামে যাচ্ছিল দুই শিশু। কিন্তু তাঁদের আর নানার বাড়ি যাওয়া হয়নি। পথিমধ্যে বাসের চাপায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা ওই দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় তাঁদের বাবা ও সিএনজি অটোরিকশায় থাকা এক যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন।
শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পাওয়া জাহাঙ্গীর এখন বাড়িতে আছেন। সন্তানদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে বিলাপ করতে করতে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘পোলাডার জানডা আমার কোলের মইধ্যে গেছে। সিএনজির মইধ্যে চাপা পইড়া মাইয়াডার পা আলগা হইয়া গেছে। বাসডা চাপ দেওনের লগে লগেই সব শেষ। আমি অহন কী লইয়া বাঁইচ্চাম। আমার তো সব শেষ হইয়া গেল।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহাঙ্গীর জানান, ওই দিন রাতে সন্তানদের মাদ্রাসা থেকে নিয়ে তিনি অলুয়া গ্রামে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিলেন। মহাসড়কের ছগুরা এলাকায় এসে তিনি একটি রিকশাভ্যানকে অতিক্রম করে বাঁ পাশেই ছিলেন। এমন সময় বিপরীত দিক থেকে আসা কুমিল্লা থেকে মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জগামী ফারজানা পরিবহনের বাস পেছনের অংশ দিয়ে তাঁর সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এতে পেছনের অংশ দুমড়েমুচড়ে গিয়ে অটোরিকশার সড়কের পাশে উল্টে পড়ে। গুরুতর আঘাত পেয়ে পা ভেঙে মেয়েটি কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে।
জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ওই বাসচালকের বেপরোয়া গতির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। আমি বাসচালকের কঠোর শাস্তির দাবি জানাই। সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি আড়াই লাখ টাকা কিস্তি নিয়ে কিনেছিলাম। এখনো এক মাসও হয়নি। এর আগেই আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
নিহত দুই শিশুর দাদি বৃদ্ধা রানু বেগমও নাতি–নাতনির জন্য বিলাপ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরার মানিক দুইডাইরে এইভাবে মারল ঘাতক বাসচালক। আমরার সব আনন্দ শেষ হইয়া গেছে। গরিব হইলেও আমার পোলাডার সাজানো সংসার আছিল, শান্তি আছিল। এহন আমার পোলাডা কেমনে বাঁচব। আমরা কেমনে বাঁচতাম।’
শিশুদের দাদা মোহাম্মদ সহিদ বলেন, ‘শুক্রবার জুমার নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে শিশুদের লাশ দাফন করা হয়েছে। ঘটনার পর সবাই ভেবেছে চাপা দেওয়া বাসটি সুগন্ধা পরিবহনের। পরে এক যাত্রীর মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি বাসটি ছিল ফারজানা পরিবহনের। ঘটনার পর বাসের মালিক চালকসহ বাসটিকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি। আমাদেরকে আজকে বিকেলে থানায় ডাকা হয়েছে। তবে আমরা টাকা চাই না, বিচার চাই।’
ওই দিন চাপা দেওয়া বাসটিতে থাকা যাত্রীদের একজনের নাম মাসকট জাহান। তিনি এ ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে বলেন, ‘ওই দিন রাতে আমি ফারজানা পরিবহনের বাসের যাত্রী ছিলাম। বিপরীত দিক থেকে আসা বাসটি অতিক্রম করার সময় সিএনজি অটোরিকশাকে পেছনের অংশ দিয়ে ধাক্কা দিলে সিএনজি অটোরিকশা সড়কের পাশে ছিটকে পড়ে। ঘটনার পর আমরা বাসটি থামানোর জন্য বললেও চালক না থামিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান। পরে আমি বাসের নম্বরটির ছবি তুলি। বাসের নাম হচ্ছে ফারজানা ট্রান্সপোর্ট আর নম্বর হচ্ছে কুমিল্লা-জ-১১-০৩৪৭ ।’
শনিবার দুপুরে মিরপুর হাইওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক পারভেজ আলী বলেন, এ ঘটনায় ওই শিশুর চাচা রনি বাদী হয়ে দেবীদ্বার থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা চালককে আসামি করা হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত ওই চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।