কুলিয়ারচরে সংঘর্ষ

‘মেয়ের বাপরে পুলিশ মাইরা ফেলছে, মেয়ে এখন কারে বাপ ডাকব’

কুলিয়ারচরে পুলিশ ও বিএনপির সংঘর্ষে নিহত রিফাত উল্লাহর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা একমাত্র মেয়েকে কোলে নিয়ে বিলাপ করছেন। আজ দুপুরে বড় ছয়সূতি দক্ষিণপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির ডাকা তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিনে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত রিফাত উল্লাহর (২২) বাড়িতে মাতম চলছে। পুলিশের গুলিতে স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন রিফাতের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা। জ্ঞান ফেরার পর থেকে তাঁর আহাজারি থামছেই না।

চার মাস বয়সী একমাত্র মেয়েকে কোলে নিয়ে রাজিয়া বিলাপ করছেন আর বলছেন, ‘আমার মেয়ের বাপ আর নাই। মেয়ের বাপরে পুলিশ মাইরা ফেলছে। আমার মেয়ে এখন কারে বাপ ডাকব? তোমরা পুলিশরে গিয়া জিগাও।’

আজ সকালে কুলিয়ারচর উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। যদিও একজন নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করে পুলিশ।

নিহত দুজন হলেন ছয়সূতি ইউনিয়নের বড় ছয়সূতি দক্ষিণপাড়ার কাউসার মিয়ার ছেলে রিফাত এবং একই ইউনিয়নের মাধবদী গ্রামের কাজল মিয়ার ছেলে বিল্লাল মিয়া (২৮)। তাঁদের মধ্যে রিফাত ছয়সূতি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি এবং বিল্লাল একই ইউনিয়নের কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন।

রিফাত উল্লাহ

দুপুরে রিফাতের বাড়িতে দেখা গেছে, গ্রামবাসী বাড়ির পাশে সড়কে বসে লাশের অপেক্ষা করছেন। ঘরে স্ত্রী রাজিয়া ও পরিবারের সদস্যরা বিলাপ করছেন। এক ঘরে শুয়ে কাঁদছেন বাবা কাউসার মিয়া। কাউসার মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে মিছিলে যাইব, জানতাম না। জানলে যাইতে দিতাম না। নির্দয় পুলিশ যা খুশি, তা করতে পারে—এই কথা তারে সব সময় বুঝাইয়া কইতাম।’

এলাকাবাসী জানান, কয়েক বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রিফাত। দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। অবরোধের প্রথম দিনে মিছিল নিয়ে ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যাওয়ার সময় সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ মাটিতে পড়ে ছিলেন। তাঁকে উদ্ধার করে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, পথেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

নিহত বিল্লাল মিয়ার (২৮) বাড়িতেও মাতম চলছে। মাধবদী গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী আন্না বেগম তিন সন্তানকে পাশে নিয়ে উঠানে শুয়ে বিলাপ করছেন। আন্না বলেন, সকালে নাশতা খেয়ে বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে যায়। মিছিলে যাবেন তিনি জানতেন না। পরে লোকজন এসে জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে আছে। তিনি বলেন, দেশের রাজনীতি ভালো না—স্বামীকে এ কথা বারবার বোঝাতেন। কিন্তু আটকাতে পারতেন না।

নিহত বিল্লাল মিয়া ছোটবেলা থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আজও তিনি সামনে থেকেই কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ মহাসড়কের পাশে পড়ে ছিলেন। অনেকের ধারণা, ঘটনাস্থলে বিল্লালের মৃত্যু হয়। বিল্লালের স্বজনেরা এসে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে পুলিশের হেফাজতে বিল্লালকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

বিল্লাল মিয়া

রিফাত ও বিল্লালের মৃত্যুর জন্য এককভাবে পুলিশকে দায়ী করছে বিএনপি। জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির উপসাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ) শরিফুল আলম বলেন, ‘আমার দুই কর্মীকে রাজপথে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। এর দায় পুলিশকে নিতে হবে।’

অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) মো. রাসেল শেখ সাংবাদিকদের বলেন, হামলাকারীরা সংখ্যায় দুই শর ওপরে ছিল। অনেকের হাতে ছিল লাঠি, কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। তাঁরা একযোগে পুলিশের ওপর হামলা চালাতে আসে। পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। একপর্যায়ে একটি ঘরে আশ্রয় নেয়। তাতেও রক্ষা পায়নি। শেষে বাধ্য হয়ে শটগানের গুলি ছুড়ে। রিফাত ও বিল্লাল পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়।