সময়ের সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছু। বদলেছে ইফতারির স্বাদ আর পদও। বগুড়ায় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে গুড় দিয়ে মুঠা পিঠা, গুড়ে মাখা খই-মুড়কি, দুধ-কলা, হালুয়া-রুটি বা গুড় মাখানো ছাতু দিয়ে ইফতার হতো। ৯ দশক পরে এখন রোজাদারদের পছন্দের তালিকায় আছে নানা রকমের ভাজাপোড়া, কাবাব বা কাচ্চি।
বগুড়ায় ইফতারের স্বাদ ও পদের গত ৯০ বছরের পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার। তিনি বলেন, চল্লিশের দশকে বগুড়া শহরে কোনো ইফতারি পদ বিক্রি হতো না। ঘরে ঘরে ইফতারি বানানো হতো। কেউ চালের গুঁড়া দিয়ে মুঠা পিঠা বানিয়ে গুড় দিয়ে খেয়ে ইফতারি সারতেন। কেউ আবার পাতে গুড়মাখা খই বা মুড়কি ও দুধ-কলায় ইফতার করতেন। কোনো কোনো বাড়িতে হালুয়া-রুটি বা ছাতু-গুড়ে ইফতার করার চল ছিল।
বজলুল করিম বাহার বলতে থাকেন, পঞ্চাশের দশকে বগুড়ার ইফতার আয়োজনে যোগ হয় হাতে তৈরি সেমাই। দুধে রান্না করা এই সেমাই গমের আটার রুটির সঙ্গে পরিবেশন করা হতো রোজাদারদের পাতে। তখন চিড়া-গুড়েও ইফতার করতেন কেউ কেউ। ইফতার আয়োজনে টক দইয়ের ঘোলের চলন শুরু হয়। শুরুর দিকে আকবরিয়া হোটেল ছাড়াও শহরের কাঁঠালতলা রেললাইনের ওপর বড় হাঁড়িতে টক দইয়ের ঘোল বিক্রি হতো। পাঁচ পয়সায় মিলত এক গ্লাস ঘোল।
শহরের প্রবীণ ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষাটের দশকে বগুড়া শহরে ইফতারি বিক্রি শুরু করে আকবরিয়া হোটেল। তখন আকবরিয়া হোটেলে বিক্রি হতো গরু ও খাসির তেহারি-বিরিয়ানি, খিচুড়ি ও ছোলা বুট। তেহারি, বিরিয়ানি মিলত ১০ পয়সায়। কাগজের ঠোঙায়, কলাপাতায় মিলত বিরিয়ানি। পরে ইফতারিতে যোগ হয় গুড়ের জিলাপি, বাতাসা, গুড়ের সন্দেশ।
স্থানীয় একাধিক প্রবীণের কথায় উঠে আসে, সত্তরের দশকে ইফতারির আয়োজনে রোজাদারদের কাছে শাহি হালুয়া ও ফিরনি জনপ্রিয় হতে থাকে। শহরের সাতমাথায় এখন যেখানে জেলা পরিষদ মার্কেট, সেখানে নানা স্বাদের হালুয়ার পসরা সাজিয়ে বসতেন দোকানিরা। বোম্বে হালুয়া, কাশ্মীরি হালুয়াসহ বাহারি স্বাদের হালুয়া মিলত এসব দোকানে। ২৫ পয়সায় মাটির হাঁড়িতে পাওয়া যেত আধা কেজি শাহি হালুয়া। এই পরিমাণ হালুয়া দিয়ে এক পরিবারের চারজন ইফতার করতে পারতেন। এই দশকে আকবরিয়া হোটেল শাহি বুন্দিয়া, রেশমি জিলাপি বিক্রির মাধ্যমে ইফতারিতে নতুন স্বাদ যোগ করে। তাদের শাহি হালিমও মানুষের মন কাড়তে শুরু করেছিল।
কবি ও কথাসাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার বলেন, আশির দশকে বগুড়ার ইফতার আয়োজনের পরিধি বাড়তে শুরু করে। পবিত্র রমজান মাসে বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হোটেল থেকে ফুটপাত, সবখানেই জমজমাট হতে থাকে ইফতারি বাজার। ক্রেতারা পছন্দের ইফতারি কিনে নিতেন এসব দোকান থেকে।
এরপর ক্রমে ইফতারিতে ভাজাপোড়া, নানা ধরনের কাবাব আর কাচ্চির মতো নানা পদ মানুষের পছন্দের তালিকায় আসতে থাকে। চল্লিশের দশকে গুড়-মুঠা পিঠা ও হালুয়া-রুটি দিয়ে যে ইফতার সম্পন্ন হতো, এখন সেখানে যোগ হয়েছে আস্ত খাসির কাবাব থেকে শুরু করে নানা খাবার। সময়ের বিবর্তনে ৫ পয়সার ঘোলের (২৫০ মিলিলিটার) দাম এখন ৫০ টাকা। আর আকবরিয়া হোটেলের খাসির মাংসের তেহারি-বিরিয়ানি ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। শহরের অভিজাত দোকানে পাওয়া যায় কাচ্চি বিরিয়ানি।
এবার বগুড়া শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁ—সবখানেই বসেছে বাহারি ইফতারির পসরা। শহরের কাঁঠালতলা, বড় মসজিদ লেনের সামনে, ফতেহ আলী মাজারের সামনে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। হরেক পদের সুস্বাদু ইফতারির স্বাদ নিতে ভিড় করেছেন রোজাদার-ক্রেতারা। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দোকানে দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে ক্রেতার।
ষাটের দশকে আকবরিয়া হোটেল বগুড়ায় প্রথমবারের মতো ইফতারি বিক্রি শুরু করেছিল। এ বিষয়ে আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল বলেন, এখানকার ইফতারি আয়োজনে ৬০ বছর ধরে ঐতিহ্য ছড়াচ্ছে টক দইয়ের ঘোল, শাহি জিলাপি, শাহি বুন্দিয়া, হালিম ও রেশমি জিলাপি। এখানকার শত পদের ইফতারির মধ্যে আছে খাসির কাবাব, লেগ কাবাব, আস্ত মুরগির ফ্রাই, খাসি ও গরুর মাংসের চাপ, সুতি কাবাব, টিকা কাবাব, জালি কাবাব, বিফ চপ, শাকপুলি, দইবড়া, পাটিসাপটা, হালুয়া, বেগুনি, চিকেন গ্রিল, চিকেন গার্লিক কাবাব, চিকেন রোল, খাসির বিরিয়ানি।
চিটাগাং নূর হোটেলের শাহি হালিম কিনতে বিকেল থেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্রেতারা। জলেশ্বরীতলা এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব বললেন, ‘প্রতিবছরই ইফতারিতে শাহি হালিম কিনি। ঐতিহ্যবাহী শাহি হালিমের সেই স্বাদ, সেই ঘ্রাণ এখনো আছে।’