যশোরের অভয়নগরে নওয়াপাড়া-মনিরামপুর সড়কের পাশে সরকারি তিনটি রেইনট্রিগাছ নিলামের আগেই কাটছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ মোল্যা। ওই দিন লোক পাঠিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এরপর এক মাস পেরিয়ে গেলেও নিলামের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ রোববার সকাল থেকে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামে ওই গাছ তিনটি আবার কাটা শুরু হয়। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে লোক পাঠিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করেন ইউএনও।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিলামের মাধ্যমে বিক্রির জন্য তিনটি রেইনট্রিগাছের মূল্য নির্ধারণ করতে সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিলেন ইউএনও। সেই অনুযায়ী সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের ফরেস্টার গাছ তিনটির সরকারি মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেন। পরে এ ব্যাপারে আর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু নিলামের আগে গাছ কাটা শুরু করা হয়। ওই দিন লোক পাঠিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করেন ইউএনও। ততক্ষণে গাছের অনেকটা কাটার কাজ শেষ হয়। এ নিয়ে ৮ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘অভয়নগরে নিলামের আগে গাছ কাটা শুরু’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর আজ থেকে নতুন করে ওই গাছ কাটা শুরু হয়।
দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, নওয়াপাড়া-মনিরামপুর সড়কের নওয়াপাড়া থেকে সুন্দলী পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য গাছ। নওয়াপাড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রানা ভাটার পাশে সড়ক ঘেঁষে একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণাধীন। বাড়ির সামনে সড়কের পাশে দুটি ও বাড়ির পাশে সড়ক ঘেঁষে আরেকটি রেইনট্রিগাছ। প্রতিটি গাছের ছাল তুলে লাল কালি দিয়ে ১, ২ ও ৩ নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা। এর মধ্যে ১ নম্বর গাছের সব ডালের ওপরের অংশ আগেই কাটা হয়েছিল। আজ ডালের নিচের অংশ থেকে কাটা হয়েছে। ২ নম্বর গাছের একটি বাদে সব ডাল কাটা হয়েছে। তবে ৩ নম্বর গাছের কোনো ডালপালা কাটা হয়নি।
ইউএনও কে এম আবু নওশাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাছ তিনটি এক ব্যক্তির। তিনি গাছ বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে চান। এ জন্য ফরেস্টারকে গাছের মূল্য নির্ধারণের জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। গাছের মূল্য নির্ধারণের প্রতিবেদনও পেয়েছি। কিন্তু গাছ কাটার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ অবস্থায় গাছ কাটার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।’
উপজেলা সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের বনপ্রহরী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ইউএনও স্যারের নির্দেশে আজ বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে কাউকে পাইনি। তবে গাছের মোটা ডাল কাটা হচ্ছিল। সেগুলো মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কাটা গাছের ছবি তুলে ইউএনও স্যারকে দিয়েছি।’
আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফ মোল্যা যশোর জেলা পরিষদের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। অভিযোগের বিষয়ে আজ তাঁর মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে প্রথমবার গাছ কাটার সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, জমির মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও বন বিভাগের মাধ্যমে গাছের মূল্য নির্ধারণ করেন। এখনো কাটার অনুমোদন দেননি। কিন্তু তিনি শ্রমিক দিয়ে একটি গাছের ডালপালা কেটে ফেলেছেন। বিষয়টি তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। এটা ঠিক হয়নি।
জমির মালিক নওয়াপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গাছ কাটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। জেলা পরিষদের সদস্য আবদুর রউফ মোল্যা লোকজন দিয়ে গাছ কাটাচ্ছেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের ১ জুলাই নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (বর্তমানে নওয়াপাড়া পৌরসভার একাংশ এবং সুন্দলী ইউপি), বেসরকারি সংস্থা ডেভেলপমেন্ট পার্টনার (ডিপি) ও সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের সদস্যদের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের ১ জুলাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। বনায়ন প্রকল্পের সদস্যদের মধ্যে ৫২ জন নারী ও ১ জন পুরুষ। তাঁরা ১৯৯৩ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় নওয়াপাড়া-সুন্দলী সড়কের ৭ কিলোমিটারে দুই পাশে বিভিন্ন প্রজাতির ১৪ হাজারের বেশি গাছের চারা লাগান। চারার যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন প্রকল্পের সদস্যরা। চুক্তি অনুযায়ী গাছ ও ফল বিক্রির টাকা থেকে নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ২০, ডিপি ২০ ও প্রকল্পের সদস্যরা ৬০ শতাংশ টাকা পাবে।
ডেভেলপমেন্ট পার্টনারের পরিচালক কানিজ শবনম বলেন, ২০১৩ সালে মেয়াদ শেষ হলেও প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় গাছের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যে গাছ কাটা হচ্ছে, সেগুলো ডিপির লাগানো। গাছের দাম দেড় লাখ টাকার বেশি হবে। এ বিষয়ে তাঁরা ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও গাছ কাটা হচ্ছে। তাঁরা দ্রুত জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেবেন।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ২ এপ্রিল ইউএনও কে এম আবু নওশাদ উপজেলা সামাজিক বন বাগান কেন্দ্রের ফরেস্টারকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে উপজেলার নূরবাগ থেকে সুন্দলী সড়ক-সংলগ্ন রানা ভাটার পাশে তিনটি রেইনট্রিগাছ নিলামের মাধ্যমে বিক্রির জন্য সরকারি মূল্য নির্ধারণ করার অনুরোধ করেন। উপজেলা ফরেস্টার তিনটি গাছের মূল্য ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে ৪ এপ্রিল প্রতিবেদন দেন। এরপর গাছ তিনটির ব্যাপারে আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।