‘এরুম বানের পানি আর দেখছি না। কিচ্ছু লইয়া ঘরের তুন বাইর হইতাম পারছি না। আবার ঘরের পিছে চিপার ভিতরে হাপ আছে। হাপের ডরে ঘরে ডুকতাম ভয় লাগেও। কিতা কইরাম আল্লায় জানে।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মুছলেন সত্তরোর্ধ ফুল মিয়া। তাঁর এত বছর বয়সে এমন বন্যা আর দেখেননি।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় যেখানে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায়, সেই বুড়বুড়িয়া এলাকা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ফুল মিয়ার বাড়ি। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের বাবা ফুল মিয়া খুব অসুস্থ। স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। গেল ২৩ আগস্ট রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভাঙলে বাড়ি থেকে বের হন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় কিছুই নিতে পারেননি।
আজ রোববার সরেজমিনে বুড়িচং উপজেলার মহিষমারা গিয়ে দেখা যায়, এখনো ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে–মেয়েরা পানিতে খেলাধুলা করছে। পাশের খালে কনুই জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন অনেকে। সড়কে মানুষের ঘরের আসবাব। সেই আসবাব থেকে বন্যার পানি মোছার কাজ করছেন অনেকে। মহিষমারা গ্রামে প্রবেশের প্রধান সড়কের পাশে চায়ের দোকানে এখনো হাঁটুসমান পানি। সেখানে জনা বিশেক লোককে দেখা যায় দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। কেউবা চা পান করছেন। তাঁদের গল্পের প্রধান বিষয়, পানি কমলে তাঁরা কী করবেন। পানি কমতে আর কত দিন লাগতে পারে।
গ্রামের ভেতর যতটা যাওয়া যায়, পানিবন্দী মানুষের হাহাকার ততই চোখে পড়ে। কথা হয় সেলিনা নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি ঘরে প্রবেশ করে দেখেন তাঁর ঘরে হাঁটুসমান কাদা। টিনের ঘর। বেড়ার নিচের মাটি ক্ষয়ে পড়ে গেছে। ঘরের ভেতর আসবাবে শেওলা পড়ে গেছে।
সেলিনা বলেন, কয়েক বছর আগে তাঁর স্বামী লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার পর থেকে তাঁর জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। দুই ছেলে ছোট। এখনো উপার্জনক্ষম হয়নি। ভাই বোন ও বাবা সহযোগিতা করেন। তাঁর ঘরে একটি টেলিভিশন। সেটি বন্যার পানিতে ভাসতে দেখে টিভিটা হাতে তুলেন সেলিনা। বলেন, তাঁর স্বামী বড় শখ করে টিভিটা কিনে দিয়েছিলেন। বন্যার পানিতে টিভিটা ভাসতে দেখে কেঁদে ফেলেন সেলিনা।
মহিষমারা এলাকার মানুষজন তাঁদের ঘরে ফিরতে চান। তবে বেশির ভাগ ঘর ভেঙে গেছে। ঘরের ভেতর হাঁটুসমান কাদা। রান্না ও টয়লেট ভেসে গেছে বানের জলে। গ্রামের মিজানুর রহমান ১১ দিন পর বাড়িতে ফিরলেন। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে এত দিন অন্যের বাড়িতে ছিলেন। মিজান বলেন, ‘কয় দিন মাইনষের বাইত (বাড়ি) থাওন যায়। আইজ বাইত আইছি। বাইত আইয়া দেহি আমার ঘরের ভেতর কিচ্ছু বালা নাই।’