কৃষক ইয়াসিন আরাফাত পয়লা বৈশাখ থেকে ধান কাটা শুরু করেছেন। সকালে ১ লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে দুপুরের মধ্যেই ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছেন ধান কাটার শ্রমিকদের। এখনো ধান কাটা বাকি অর্ধেক।
ইয়াসিন বলেন, এবার তিনি করিমগঞ্জ ও নিকলী সংযোগ বড় হাওরে ১৭ কানি জমিতে ব্রি-২৮ ধান চাষ করেছিলেন। আগামজাত বলে বেশি লাভের আশায় এ ধান রোপণ করেছিলেন। কিন্তু গতকাল শুক্রবার ধান কাটতে গিয়ে তাঁর উৎসবে ভাটা পড়েছে।
গতকাল দুপুরে বড় হাওরে গিয়ে দেখা যায়, ধান কাটার উৎসব চলছে। একদিকে একদল শ্রমিক ধান কাটছেন, অন্যদিকে আরেক দল শ্রমিক ধান মাথায় করে এনে সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখছেন। এখান থেকে আবার ট্রাক, লরি টমটম ও মহিষের গাড়ি দিয়ে ধান এনে মেশিন দিয়ে মাড়াই করছেন কেউ কেউ।
করিমগঞ্জের জয়কার কৃষক ইয়াসিন বলেন, এবার তিনি ১৭ কানি জমিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে ব্রি-২৮ ধান চাষ করেছিলেন। নেক ব্লাস্টে আক্রমণ না করলে তিনি ২৫০ মণ ধান থেকে চার থেকে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা পেতেন। তিনি ধান পেয়েছেন মাত্র ১০০ মণের মতো। এখন দেড় লাখ টাকার ধানও তিনি বিক্রি করতে পারবেন না। নেক ব্লাস্টের কারণে তাঁর অর্ধেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও যা ধান আছে, তা কাটতে তিনি সকালে ১ লাখ টাকা নিয়ে এসে ৩১ জন ধান কাটার শ্রমিক ও গাড়ি ভাড়ার জন্য ৭০ হাজার টাকা বেলা দুইটার মধ্যে শেষ করে ফেলেছেন। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা একজন শ্রমিকের মজুরি দিয়ে আবার ৫ হাজার টাকা কানি জমিতে ধান কাটার চুক্তি দিয়ে সেই ধান বিক্রির পর কিছুই থাকে না। কৃষকদের কষ্ট কেউ বুঝে না।
কৃষক নূরুল ইসলাম বলেন, তিনি ৬ কানি জমিতে বি–২৮ ধান করেছিলেন। প্রায় সব ধান নেক ব্লাস্টে নষ্ট হওয়ায় জমি থেকে শুধু গরুর জন্য খড় কেটে আনছেন। তবে খড়ের দামও ৬০০ টাকা মণ।
কৃষক সুজন মিয়া বলেন, এক মণ ধানে এক কামলা। এক মণ ধান উৎপাদনে হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ে। কিন্তু সেই ধান এখন ৭০০ টাকা করে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ এ ধান যদি মণপ্রতি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা হতো, তাহলে কৃষকেরা কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পারতেন।
কৃষক কাদির মিয়া জানান, ১ কানি জমি অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ জমির ধান কাটতে শ্রমিকদের দিতে হয় ৫ হাজার টাকা আর সেই ধান নিতে আরও গাড়িভাড়া লাগে ২ হাজার টাকা। মোট সাত হাজার টাকা শুধু কানিতে কাটা ও আনা–নেওয়ার খরচ। তবে ধানের ভালো ফলন হলে কানিপ্রতি ২২ মণ থেকে ২৫ মণ ধান পাওয়া যেত, কিন্তু নেক ব্লাস্টের আক্রমণের কারণে কানিপ্রতি ১০ থেকে ১২ মণ ধান পাচ্ছেন। অনেকে আবার জমিতে কাঁচিও ধরতে পারেননি।
বড় হাওরের কৃষক বাচ্চু মিয়া, আমিন মিয়া ও রুমান মিয়া জানান, তাঁরা শুধু তাঁদের জমি থেকে খড় কেটে এনেছেন গরুর খাবারের জন্য। যে কারণে তাঁরা আর আগামী দিনে আগাম ফসল তোলার আশায় ব্রি-২৮ ধান চাষ করবেন না। এমন অবস্থার মধ্যেই কৃষকেরা তাঁদের স্বপ্নের ধান কাটা শুরু করেছেন। তবে এবার ব্রি-২৯ ধানসহ অন্যান্য ধানের ফসল খুবই ভালো হয়েছে। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, তাহলে বাম্পার সোনালি ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এখন ব্রি-২৮ ধান কাটা হচ্ছে। তবে ১৫ দিন পর থেকে ব্রি-২৯–সহ অন্যান্য ধানও কাটা শুরু হবে বলে জানান কৃষকেরা।
কৃষকেরা আরও জানান, ব্রি-২৮ ধান রোপণের পর ধানের চারাও তরতাজা ও সতেজ হয়ে উঠছিল। কিন্তু যেই না গাছে ধান আসছে তখন থেকেই গাছের বের হওয়া ধান নেক ব্লাস্ট রোগে সাদা হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২০ হেক্টর। অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৯০ হেক্টর। এর মধ্যে শুধু হাওরাঞ্চলে চাষ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে ব্রি-২৮ ধান, যেগুলোতে নেক ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছে, সেগুলো ৩০ শতাংশ জমিতে চাষ করা হয়েছে।
সরেজমিন করিমগঞ্জের জয়কা, গুণধর; হাওর–অধ্যুষিত নিকলীর সদরসহ ইটনা উপজেলার এলংজুরি, বড়িবাড়ি, সোহেলা, ইটনারবড় হাওরসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য কৃষকের চাষ করা ব্রি-২৮ জাতের ধানের শিষ বের হওয়ার পর শিষগুলো পচে শুকিয়ে চিটে হয়ে গেছে। এসব জমি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন। তবে কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি কর্মকর্তারা যদি তাঁদের সময়মতো ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন, তাহলে হয়তো তাঁরা এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতেন না।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবদুস সাত্তার বলেন, এক সপ্তাহ ধরে কৃষকেরা বি–২৮ ধান কাটা শুরু করেছেন। জেলার ২৮ হাজার হেক্টর ব্রি-২৮ ধানের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৮ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। বাকি এক সপ্তাহ আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সব বি–২৮ ধান কাটা হয়ে যাবে। এর পর অন্য ধানও কাটা শুরু হবে।
আবদুস সাত্তার আরও বলেন, ‘বিরূপ আবহাওয়া কারণে নেক ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ কিছু কিছু এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আমরা কৃষকদের এই রোগ থেকে প্রতিকারের পরামর্শ দিয়েছিলাম আগে থেকেই যাতে প্রয়োজনীয় কীটনাশক স্প্রে করা হয়। এ ছাড়া আমরা কৃষকদের ব্রি–২৮ ধান চাষ করতে নিরুৎসাহিত করি। কারণ, এই জাত অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। তবু ব্রি-২৮ ধানের চাল ভালো ও খেতে সুস্বাদু এবং আগাম জাত হওয়ায় আমাদের পরামর্শ না থাকলেও এ ধান চাষ করেন কৃষকেরা।’