জিম্মি জাহাজ থেকে বাবাকে প্রকৌশলী

‘আল্লাহ জানে কী হবে, শক্ত থাইকেন, দোয়া রাইখেন’

জিম্মি জাহাজের তৃতীয় প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার বেলা ১টা ৩১ মিনিটে দেলোয়ার হোসেনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে তিনটি বার্তা পাঠান ছেলে মো. তরিকুল ইসলাম। বার্তায় লেখা ছিল, ‘আব্বু মাফ কইরেন আমাকে, দোয়া করেন আমাদের জন্য।’ ছেলের বার্তা দেখে কিছুক্ষণের জন্য হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন দেলোয়ার। কারণ, ছেলে বার্তা নয়, সব সময় কল করেন।

উত্তরে দেলোয়ার লেখেন, ‘মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন তোমাদের নেক হায়াত দান করেন। শারীরিকভাবে সুস্থ রাখেন, বেশি বেশি হালাল রুজি উপার্জনের তৌফিক দেন।’

কিন্তু ছেলে কোনো উত্তর না দেওয়ায় আবার লেখেন, ‘আব্বু কী অবস্থা তোমাদের? আমাকে জানাও।’ এরপর বেলা ৩টা ৫৫ মিনিটে উত্তরে ছেলে লেখেন, ‘ঠিক আছি, টেনশন কইরেন না, দোয়া করেন।’ তখনো নিজেদের জিম্মি হওয়ার ঘটনা বাবাকে বলেননি ছেলে।

১ মিনিট পর ৩টা ৫৬ মিনিটে সাত লাইনের ইংরেজি বার্তা পাঠান। সেখানে জাহাজ ও কোম্পানির নাম লিখে লেখেন, ‘২০ জনের বেশি জলদস্যু জাহাজে উঠে গেছে, প্রায় ১০০ জন আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমরা জিম্মি। আল্লাহ জানে কী হবে। শক্ত থাইকেন, দোয়া কইরেন।’ এরপর বাবা লেখেন, ‘আল্লাহর কুদরতি সাহায্য তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।’ এরপর বিকেল ৫টা ৩৭ মিনিটে ছেলে বাবাকে শুধু একটাই উত্তর দেন, ‘ইনশা আল্লাহ।’ এরপর ছেলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি দেলোয়ার হোসেন।

এভাবেই ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথোপকথনের কথা বলছিলেন ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকরিকান্দি গ্রামের মো. তরিকুল ইসলামের (২৯) বাবা দেলোয়ার হোসেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টার দিকে সোমালিয়ার জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ে যাচ্ছিল। জাহাজে তরিকুলসহ ২৩ বাংলাদেশি আছেন। তরিকুল ওই জাহাজের তৃতীয় প্রকৌশলী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তরিকুল সবার ছোট। তাঁর এক বছর বয়সী মেয়ে তানজিহা ইসলামের প্রথম জন্মদিন ছিল গত ২২ ফেব্রুয়ারি।

সন্তানের ফেরার অপেক্ষায় তরিকুলের বাবা দেলোয়ার হোসেন ও মা হাসিনা বেগম

বুধবার বিকেলে ছকরিকান্দি গ্রামে তরিকুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। ঘরে দাদি, মা-বাবা ছাড়া কেউ নেই। স্ত্রী নুসরাত মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আছেন।

তরিকুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার বাবারে দস্যুরা আটকাইয়া রাখছে। জানি না, আমার বাজান কেমন অবস্থায় আছে। আমি আমার বাজানরে ফেরত চাই। আমার বাবারে আইনা দাও।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমার ছেলে নয়, সরকারের কাছে ডাকাতদের হাতে জিম্মি সবার মুক্তির দাবি জানাই।’

স্বজনেরা জানান, বাড়ির পাশে ছকরিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে রাজধানীর মিরপুরে ডক্টর শহীদুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষে ২০১৭ সালে চীনের একটি কোম্পানির একটি জাহাজে চাকরি নেন। এরপর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে গত বছরের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের এসআর শিপিং লিমিটেডের এই জাহাজে চাকরি নেন।

তরিকুলের দাদি কুলসুম বেগম বলেন, ‘কোরবানির ঈদে আমার দাদু ভাই বাড়িতে আইছিল। ওর মেয়ের জন্মদিনে আমাগো সবার সাথে ভিডিও কলে কথা কইল। কথা কইলেই আমারে জিগাইত, “দাদি তোমার জন্য কী আনব?” আমার শান্ত নাতিডারে কোন ডাকাতে ধরল! আমি আমার নাতিরে ফেরত চাই।’

স্ত্রী–সন্তানের সঙ্গে তরিকুল ইসলাম

ছকরিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা সজীব মিয়া বলেন, ‘ওদের এই বিপদে আমাদের সত্যিই মন খারাপ হয়। আল্লাহ যেন ওদের সহিসালামতে ফিরিয়ে আনেন। মায়ের বুকের সন্তান মায়ের বুকে ফিরে আসুক।’ রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ঘটনাটি শোনার পর থেকে তাঁরা প্রশাসনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অনুরোধ করেছেন, যাতে তরিকুলসহ জিম্মি সবাইকে সরকার জীবিত ফিরিয়ে আনে।