চলছে কবর খোঁড়ার কাজ। গত রোববার বান্দরবানের রুমায় জঙ্গি আস্তানায়
চলছে কবর খোঁড়ার কাজ। গত রোববার বান্দরবানের রুমায় জঙ্গি আস্তানায়

বান্দরবানের পাহাড়ি খাদে শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী এক অভিযান

বান্দরবানে রুমায় দুর্গম পাহাড়ি খাদে র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা গত রোববার শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী এক অভিযান চালিয়েছেন। গ্রেপ্তার জঙ্গিদের তথ্যের ভিত্তিতে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও জঙ্গিগোষ্ঠী জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার গোপন আস্তানা এবং মৃত এক জঙ্গির কবরের সন্ধানে লুয়াংমুয়ালপাড়া এলাকায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে ওই অভিযান।

অভিযানের তথ্য সংগ্রহ করতে সাংবাদিকেরা জেলা সদর থেকে থানচি হয়ে ১০৮ কিলোমিটার দূরে গাড়িতে ও পায়ে হেঁটে রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের লুয়াংমুয়ালপাড়ায় যান। পাড়াটি রুমা উপজেলায় হলেও থানচি উপজেলা সদর থেকে ২৯ কিলোমিটার ও রুমা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। যৌথ আভিযানিক দলে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকও ছিলেন।

জঙ্গি আস্তানায় ব্যবহৃত হাড়ি–পাতিল

লুয়াংমুয়ালপাড়ায় আগে থেকে র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর আভিযানিক দলটি অবস্থান নিয়েছিল। পাড়ায় দেখা যায়, বাড়িঘরে ধানের গোলা, থরে থরে সাজানো থুরুং (বাঁশের ঝুঁড়ি), জুমের আলু, কাজুবাদামসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। চরে বেড়ানো গয়াল, ছাগল দেখে বোঝা যায়, পাড়াবাসী সুখে ছিলেন। কিন্তু বাড়িঘরে জনমানুষের নিশানা নেই। অভিযানে সহযোগিতায় আসা তামলাওপাড়ার বমরা জানিয়েছেন, কেএনএফ, জঙ্গিগোষ্ঠীর অত্যাচারে ও নানামুখী চাপে পাড়াবাসী টিকতে না পেরে কোথাও চলে গেছেন। একইভাবে পাশের পাইনূয়ামপাড়ায়ও কোনো মানুষ নেই।

লুয়াংমুয়ালপাড়ার জনমানবশূন্য ফাঁকা ঘরবাড়ি

জঙ্গিরা কী তথ্য দিয়েছেন

কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া সালেহ আহমেদ (২৭) ও ১৭ বছরের একজনকে ১১ জানুয়ারি থানচি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন, লুয়াংমুয়ালপাড়া এলাকায় শারক্কীয়া ও কেএনএফের গোপন আস্তানা রয়েছে। ওই আস্তানায় আমিনুল ইসলাম আল আমিন (২৩) অসুস্থ ও অভুক্ত অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁর বাড়িও কুমিল্লায়। সেখানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছে।

জঙ্গি আস্তানার আশপাশে পাথরের গায়ে খোদাই করা লেখা

হেলিকপ্টারে লুয়াংমুয়ালপাড়ায়

রোববার দুপুর ১২টায় লুয়াংমুয়ালপাড়ায় হেলিকপ্টার নামে। অভিযানে অংশ নিতে হেলিকপ্টারে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান, আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন, রুমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন শিবলী, পুলিশের উপপরিদর্শক আলমগীর হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজন এসেছেন। আল আমিনের লাশ শনাক্তের জন্য তাঁর বাবা মো. নুরুল ইসলামকেও নিয়ে আসা হয়।

শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান

দুপুর সাড়ে ১২টায় দুই জঙ্গিকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার পশ্চিম পাশে একটি জঙ্গলাকীর্ণ পথ ধরে অভিযানে নামে র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। প্রায় আধা কিলোমিটার যেতেই অরণ্যঘেরা খাড়া পাহাড়ের গভীর খাদ। গাছ ও বাঁশ ধরে কিছু দূর নামতেই দেয়ালের মতো খাদের খাড়া ঢাল। এর মধ্যে এক কর্মকর্তা মাথা ঘুরে পড়ে যান। গাছ-বাঁশ ধরে আর নামা সম্ভব না হওয়ায় গাছে রশি বেঁধে নামা শুরু হয়। র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের সঙ্গে রশিতে ঝুলতে ঝুলতে অনেকে নামতে পারেননি। রশি থেকে ছুটে পড়ার ভয় নিয়ে রুমার ইউএনও, তাঁর সহকারী ও এই প্রতিবেদক ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকেন। তিনটি ধাপ কমান্ডোদের সঙ্গে রশিতে ঝুলে নামার পর খাদের ঝিরির সন্ধান পাওয়া যায়। ওপর থেকে খাদ বেয়ে নিচে নামতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল।

নিচে নেমে অপারেশন কমান্ডার সবাইকে করণীয় সম্পর্কে ব্রিফ করলেন। তাজিংডং পাহাড় থেকে নেমে ঝিরিতে অসংখ্য পাথর। পানিতে পা না ফেলে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ দিয়ে ঝিরির আধকিলোমিটার ভাটিতে বাঙ্কারসহ একটি প্রহরাচৌকি (সেন্ট্রিপোস্ট) পাওয়া যায়। দুরুদুরু বুকে সামনে কিছু দূর এগোতেই গোপন আস্তানা চোখে পড়ে। ভেঙে পড়া তিনটি বাঁশের ঘরে বম নারীদের কোমড়তাঁতের তৈরি গিলাপকাপড়, শার্ট, প্যান্ট, হাঁড়ি–পাতিল ও বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হয়, ঘরগুলো ভেঙে বাসিন্দারা পালিয়েছেন। আশপাশের বড় বড় পাথরে ইংরেজিতে কেএনএফ অক্ষর তিনটি খোদাই করা দেখা গেল। গোপন আস্তানার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কয়েক শ গজ দূরে কবরের মতো মাটিচাপা স্থান। সেটি খনন করে কম্বল ও বাঁশের টুকরো ছাড়া কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।

আল আমিনের বাবা নুরুল ইসলামের কান্না যেন থামছেই না

সন্তানহারা বাবার কান্না

কবর সন্দেহে মাটিচাপা দেওয়া স্থানে লাশ না পেয়ে জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যমতে, মৃত আল আমিনের বাবা নুরুল ইসলামের কান্না থেমে যায়। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এরপর আস্তানা থেকে একটি ট্র্যাকস্যুট কুড়িয়ে নেন। ধারণা করেন, সেটি ছেলে আল আমিনের। আল আমিনের মাকে দেখাতে নিয়ে যাবেন। মা শনাক্ত করতে পারবেন। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রলোভনে ফেলে মা-বাবার বুক যাঁরা খালি করছেন, আমি তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। ভবিষ্যতে যাতে কোনো মা-বাবার বুক খালি না হয়।’

দুই জঙ্গিকে নিয়ে অভিযান চালান র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর সসদ্যরা

জঙ্গিরা যা বলেন

অভিযানের সময় সঙ্গে থাকা দুই জঙ্গির মধ্যে আবু সালেহ ওরফে সাইহা কেএনএফের সঙ্গে দুই বছর ধরে বিভিন্ন আস্তানায় ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে কেএনএফের আস্তানা ও প্রশিক্ষণ ছাউনিগুলো ধ্বংস অথবা বন্ধ হয়ে যায়। জঙ্গিরা বিভিন্ন দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সর্বশেষ তাঁরা কেএনএফের সিলোপীপাড়া আস্তানা থেকে লুয়াংমুয়ালপাড়া এলাকার আস্তানায় এসেছিলেন।

অভিযানের সময় র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেছেন, তাঁদের পাওয়া তালিকামতে ৫৫ জন শারক্কীয়া জঙ্গি কেএনএফের প্রশিক্ষণ ছাউনিতে ছিলেন। সেখান থেকে এ পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে।

জঙ্গি আস্তানায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটানোর পর এবার ওপরে ওঠার পালা। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রশি বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন আভিযানিক দলের সদস্যরা। অনভ্যস্ততায় পাহাড়ি খাদের মাঝমাঝি উঠতে অনেকের গলদঘর্ম দশা। ঘণ্টা দেড়েকের বেশি সময় লাগল ওপরে উঠে আসতে। ততক্ষণে একেকজনের হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে, গা ব্যথায় টনটন করছে। সন্ধ্যার দিকে পাহাড়ি জঙ্গল মাড়িয়ে দলটি আবার লুয়াংমুয়ালপাড়ায় এল।