কুয়াশা ভেদ করে সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গায়ে টি-শার্ট, হাফপ্যান্ট আর পায়ে কেডস। মহাসড়ক ধরে কখনো লম্বা পায়ে, কখনো ধীরগতিতে দৌড়াচ্ছেন মোহাম্মদ আলামিন (২৪)। পাক্কা ২১ কিলোমিটার দৌড়ে তাঁকে পৌঁছাতে হবে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে। আলামিন ছুটছেন আপন মনে। মাঝেমধ্যে হাতের রুমালে মুখ মুছছেন।
দিনাজপুর নাগরিক উদ্যোগ আয়োজিত ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন আলামিন। আজ শনিবার সকাল ছয়টায় শহরের ইনস্টিটিউট মাঠে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠন নবরূপীর সভাপতি আবদুস সামাদ চৌধুরী। প্রতিযোগিতার এবারের প্রতিপাদ্য, ‘মাদকের বিরুদ্ধে, এসো দৌড়াই আলোর পথে।’
প্রতিযোগিতায় পাবনা, নরসিংদী, রাজশাহীসহ ১৫টি জেলা থেকে ৩ শতাধিক দৌড়বিদ অংশ নিয়েছেন। ম্যারাথনে ছেলেদের মধ্যে আলামিন ও নারীদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন সামিয়া আক্তার। আলামিন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সামিয়া পাবনার আটঘরিয়া কলেজের স্নাতকের ছাত্রী। গতবারও তাঁরা দুজন প্রথম হয়েছিলেন।
গন্তব্যে পৌঁছে ঘড়ি দেখলেন আলামিন। ১ ঘণ্টা ১৪ মিনিটে পৌঁছেছেন তিনি। তিন শতাধিক প্রতিযোগীর মধ্যে আলামিন প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। আলামিনের বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পলাশবাড়ি গ্রামে। বর্তমানে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
চার ভাইবোনের মধ্যে আলামিন বড়। গত বছরও এ ম্যারাথনে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত ৩৩টি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ম্যারাথনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও জিতেছেন।
মন্দির প্রাঙ্গণে আলাপচারিতায় আলামিন জানান, ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন খেলাধুলার মধ্যে ছিলেন তিনি। বড় হয়েছেন বাবার অভাবের সংসারে। ২০১৫ সালে যখন সবে এসএসসি পাস করেন, তখন রিকশাচালক নানার কাছে দিনাজপুরের ম্যারাথনের কথা জানতে পারেন। কেডস কেনার টাকা না থাকায় স্যান্ডেল পরে অংশ নিয়েছিলেন। অংশগ্রহণ করে সেবার প্রথম হন।
আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দৌড়ানোটা শখ ও নেশা ছিল। এখন পেশায় পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে দৌড়বিদদের অনেক গ্রুপ আছে। সেখানে যোগাযোগ রাখি। অনেক সময় আয়োজকেরাও ফোনে জানান। আমি ছুটে যাই। তবে আমাদের দেশে ম্যারাথনকে খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এখনো কার্পণ্য করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, একজন দৌড়বিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ডায়েট প্ল্যান অনুসরণ করা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া; সর্বোপরি স্বপ্ন দেখতে শেখা ও ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত করা।
পাঁচ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলার ম্যারাথনে অংশ নিই। দৌড়ানোটা নেশা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ১৫টি জেলায় এ পর্যন্ত ২২টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। স্ত্রী-সন্তানকেও সঙ্গে নিয়ে যাই।ব্যাংক কর্মকর্তা অধীশ্বর রায় (৩৭)
ম্যারাথনে নারীদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন সামিয়া আক্তার। পাবনা আটঘরিয়া কলেজের স্নাতকের ছাত্রী। গতবারও প্রথম হয়েছিলেন তিনি। সামিয়া বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে দৌড়ানো আনন্দ অনেক বেশি। দিনাজপুরের আয়োজন অনেক সুন্দর।’
রাজশাহী জেলা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ম্যারাথনে অংশ নিতে আসেন অধীশ্বর রায় (৩৭)। তিনি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সতীহাট শাখায় কর্মরত। অধীশ্বর বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলার ম্যারাথনে অংশ নিই। দৌড়ানোটা নেশা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ১৫টি জেলায় এ পর্যন্ত ২২টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। স্ত্রী-সন্তানকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। প্রতিযোগিতার পাশাপাশি পরিবারকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোও হয়ে যায়।’
১১ বছর ধরে এই ম্যারাথনের আয়োজন করছে দিনাজপুর নাগরিক উদ্যোগ। আয়োজকেরা বলেন, এবারের প্রতিযোগিতায় তিন শতাধিক দৌড়বিদ অংশ নিয়েছেন। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুর, নীলফামারীসহ ১৫টি জেলা থেকে প্রতিযোগীরা এসেছেন। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়সহ মোট ১০ জনকে অর্থ পুরস্কারসহ অংশগ্রহণকারী সবাইকে সনদ দেওয়া হয়েছে। দুপুরে মন্দির প্রাঙ্গণে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন দিনাজপুর-৫ (পার্বতীপুর ও ফুলবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ও দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ ও কাহারোল) আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল।
ম্যারাথনের আয়োজক নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, সুস্বাস্থ্য একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খেলাধুলা ও শরীরচর্চার মধ্য দিয়ে একটি জাতির শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক কালে তারুণ্যের শক্তিকে গ্রাস করছে ভয়াবহ মাদক। তরুণদের মাদক থেকে দূরে রেখে খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি দিনাজপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার কাজটি করে যাচ্ছেন তাঁরা।