পাহাড়ঘেরা বান্দরবানে কবে কখন কারা বসতি স্থাপন করেছিল, এর কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবে বেশ কয়েকজন ইংরেজ লেখকের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে এ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
বান্দরবান নামের কোনো জনপদের অস্তিত্ব ছিল না আজ থেকে আড়াই শ বছর আগেও। ছিল না আজকের মতো জনবসতি।
বান্দরবান জেলা শহর গোড়াপত্তনের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ‘বোমাং রাজগুরু বৌদ্ধবিহার’। মারমারা তাঁদের ভাষায় বলেন, ‘খ্যংওয়াহক্যং’। ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিহারই জেলার একমাত্র প্রাচীন স্থাপনা। রাজগুরু বিহারের বয়স এখন ১৩০ বছর। অবশ্য তারও ৯০ বছর আগে বান্দরবানে বসতি স্থান করেছিলেন বোমাং রাজারা। নবম বোমাং রাজা ‘সাক হ্না ঞো চৌধুরী’ রাজগুরু বিহার নির্মাণ শুরু করেছিলেন। শুরুতে বিহারটি ছিল ৮০ ফুট দীর্ঘ ও ৬০ ফুট প্রশস্ত বর্মি রীতির একটি মাচাংঘর। বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে মূল্যবান ধাতুর বুদ্ধমূর্তি এনে স্থাপন করা হয়েছিল। বিহারের প্রবেশের দুই পাশে দুটি সিংহমূর্তি স্থাপন করা হয়।
এই বৌদ্ধবিহার স্থাপনের ৯০ বছর আগেই বোমাং রাজারা আরাকান থেকে এসে বান্দরবানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বোমাং রাজা কং হ্লা প্রু চৌধুরী আমলে ১৮০৪ সালে রাজপরিবার ও তাঁদের অনুসারীরা ওই অঞ্চলে আসেন। তখন শ্বাপদসংকুল গহিন অরণ্যে টিকে থাকতে পারবেন কি না, এ নিয়ে সন্দেহ ছিল তাঁদের। প্রায় ৯০ বছর ধরে এমন দোলাচলে ছিলেন তাঁরা। এ কারণে কোনো স্থায়ী স্থাপনাও তৈরি করেননি। বাঁশ ও গাছের খুঁটির ওপর মাচাং তৈরি করে থাকতেন তাঁরা। বোমাং রাজবাড়িও ছিল মাচাংয়ের তৈরি। তবে ১৮৯৪ সালের দিকে বোমাং রাজা ও তাঁর অনুসারীরা ধীরে ধীরে ওই এলাকায় স্থায়ী ঘর বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তখনই নির্মিত হয় রাজগুরু বৌদ্ধবিহার।
বোমাং রাজাদের নতুন বসতির কোনো নাম ছিল না শুরুতে। ওই বসতির দক্ষিণ পাশে একটি খাল দিয়ে পারাপার হতো গহিন বনের বানরের দল। বানর পারাপারের দৃশ্য দূর থেকে দেখে মনে হতো বাঁধের মতো। ওই এলাকায় নতুন আসা মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন যার নাম দিয়েছিল ‘ম্যয়ক সে’। যার অর্থ বানরের বাঁধ। ‘ম্যয়ক সে’ শব্দটি পরবর্তী সময়ে বাংলাভাষীদের মুখে মুখে হয়ে দাঁড়িয়েছিল বান্দরবান। বানরের দল যে খাল দিয়ে পারাপার হতো, তার নাম রাখা হয় ‘ম্যয়ক সে’ খাল। ‘ম্যয়ক সে’ খালই পরবর্তী সময়ে মুখে মুখে ‘ম্যাক্সি খালে’ পরিণত হয়।
রাজপরিবারে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২২ সালে বোমাং রাজপরিবারের প্রধানকে চিফ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন রাজপরিবার শঙ্খ নদের (সাঙ্গুর স্থানীয় নাম) পশ্চিম তীর থেকে পূর্ব তীরে স্থানান্তর হয়েছে মাত্র। বান্দরবানে ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। রাজপরিবারও স্থায়ীভাবে বান্দরবানে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর নবম বোমাং রাজা সাক হ্না ঞো চৌধুরীর আমলে ১৮৯৪ সালে রাজগুরু বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বান্দরবানে আসার আগে আরাকানফেরত বোমাং রাজপরিবার সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়ার বোমাং হাটে বসবাস করত। বাজালিয়ায় বোমাংদের অনুসারী মারমাদের বসবাসের কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত গবেষক ফ্রান্সিস বুকানন।
ব্রিটিশ গবেষক ফ্রান্সিস বুকানন ইস্ট–ইন্ডিয়ার কোম্পানির আদেশে মসলা চাষের জমি সন্ধানের জন্য ১৭৯৮ সালে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর ভ্রমণ বিবরণী নিয়ে ‘দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন’ নামের একটি বইও প্রকাশিত হয়। বইটি সম্পাদনা করেছেন ভেলাম ভান সেন্দেল। ভ্রমণ বিবরণী অনুযায়ী, বুকানন ১৭৯৮ সালে বাজালিয়া থেকে কিছু দূরে সুয়ালকে জুমিয়াপ্রধান পো-মাঙ কং হ্লা প্রুর সঙ্গে দেখা করেন। পো-মাঙ বা বোমাং উপাধিধারীরাই বান্দরবানের বোমাং রাজা। বুকানন লিখেছেন, পো–মাঙ কাংয়ের বাড়ি অন্য জুমিয়াদের ঢঙেই নির্মিত, তবে তুলনায় অনেক বড়। চেয়ার, কার্পেট, বিছানা, মাদুর ও অন্যান্য আসবাব আছে বাড়িটিতে।
ফ্রান্সিস বুকাননের সঙ্গে সাক্ষাতের ছয় বছর পর বোমাং রাজা পরিবার ও তাঁর অনুসারীরা স্থানান্তর হয়ে বান্দরবানে বসতি গড়ে তোলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইনের লেখা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লুসাই পাহাড় বইয়ের ১৮৬৬-৬৭ সালের বিবরণীতেও বোমাং রাজপরিবারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইতিহাস বলে, আরাকানি রাজাদের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে বোমাং রাজারা নাইক্ষ্যংছড়ি, রামু, লামা, চকরিয়া ও সাতকানিয়ার বাজালিয়া হয়ে বান্দরবানে এসে বসতি স্থাপন করেন। একসময় শহরে বড় রাজবাড়ি থাকলেও তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এখন শুধু রাজগুরু বৌদ্ধবিহারই বান্দরবানের ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে।
বোমাং রাজা ক্যজ সাইন চৌধুরী ১৯৩৮ সালে স্থাপত্য অক্ষুণ্ন রেখে বিহারটি পুনর্নির্মাণ করেছেন বলে জানিয়েছেন রাজগুরু বিহারের ভিক্ষু কৌধন্য। তখন বার্মা থেকে প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি নিয়ে আসা হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম বুদ্ধমূর্তি একটি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবরের একটি প্রতিবেদনে বুদ্ধমূর্তি ৫৫০ থেকে ৮০০ বছরের পুরোনো হতে পারে উল্লেখ করা হয়েছে। মারমা এই বুদ্ধমূর্তিকে আসাইম্রাইং বলে অভিহিত করে।
রাজগুরু বিহারের বিহারাধ্যক্ষ উ কেতু মহাথের বলেছেন, প্রাচীন স্থাপত্য নকশা ঠিক রেখে রাজগুরু বিহার অনেকবার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হয়েছে। এখন ১৩০ বছর আগের গাছ ও বাঁশের বিহার নেই, তবে পাকা ভবনে সেই স্থাপত্য ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা হয়েছে।