উত্তরের চার জেলা

২১ গুপ্ত হামলা, ব্যবস্থা নিতে পুলিশের গড়িমসি

  • গত আড়াই মাসে নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী ও নাটোরে ২১ গুপ্ত হামলা।

  • পুলিশ বলছে, হামলার শিকার ব্যক্তিরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন না।

  • আদমদীঘির হামলাকারীদের কারও মাথায় হেলমেট, কারও মুখে মাফলার বাঁধা ছিল।

অপরাধ

উত্তরাঞ্চলে কয়েকটি জেলায় গুপ্ত হামলার ঘটনা থামছেই না। কী কারণে এসব হামলা হচ্ছে, কারা জড়িত—সেই রহস্য ভেদ হয়নি। এমনকি মুখোশধারীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন। আর পুলিশ বলছে, হামলার শিকার ব্যক্তিরা তথ্য দিয়ে তাদের সহায়তা করছেন না।

সর্বশেষ গত শনিবার বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় একজন মৎস্যচাষির ওপর গুপ্ত হামলার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গত আড়াই মাসে নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী ও নাটোরে ২১টি হামলার ঘটনা ঘটল। এসব হামলায় এ পর্যন্ত এক বিএনপি নেতাসহ দুজন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের তিন নেতা-কর্মী। বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

আদমদীঘিতে হামলার ঘটনায় মামলার বাদীর অভিযোগ, শুরুতে পুলিশ গড়িমসি করে। পরে এজাহারে অনেক জায়গায় পরিবর্তন করে মামলা নিয়েছে।

গত শনিবার আদমদীঘি উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হেঁটে গ্রামের পাশে পুকুরে যাওয়ার সময় আবদুর রশিদ (৬০) নামের এক মৎস্যচাষির ওপর হামলা চালিয়ে গুরুতর জখম করে মুখোশধারীরা। পালিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসী দুজনকে আটক করে পুলিশে দেন। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে দুটি রড উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় আহত মৎস্যচাষির ছেলে রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রোববার আদমদীঘি থানায় আটক দুই যুবকের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরও ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। আহত আবদুর রশিদ বর্তমানে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

গতকাল মঙ্গলবার বাহাদুরপুর ও বিহিগ্রামে গিয়ে কথা হয় আবদুর রশিদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, হামলাকারীরা দুটি মোটরসাইকেলে মোট পাঁচজন ছিলেন। তাঁদের কারও মাথায় হেলমেট, কারও মুখ মাফলার ও কাপড়ে ঢাকা ছিল।

মামলার বাদী রফিকুল ইসলামের অভিযোগ, ‘পুলিশ মামলা নিতে অনেক গড়িমসি করেছে। পরে মামলা নিলেও এজাহারে আমরা যা লিখেছিলাম, সেটার অনেক জায়গায় পরিবর্তন করে এজাহার নিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া গ্রেপ্তার দুই ব্যক্তির কাছ থেকে রড ও চাকু পাওয়া যাওয়ার পরও পুলিশ এখন পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করেনি। এ ঘটনা নিয়ে শুরু থেকেই পুলিশের একটা গা ছাড়া ভাব। এই হামলার নেপথ্যে কারা জড়িত, তাঁদের পরিচয় জানতে চাই আমরা।’

জানতে চাইলে বগুড়ার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. নাজরান রউফ প্রথম আলোকে বলেন, মৎস্যচাষিকে হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার দুই যুবক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা নাকি ওই দিকে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। হামলার রহস্য উদ্‌ঘাটনে অভিযুক্ত ওই দুজনের বিরুদ্ধে শিগগিরই রিমান্ড আবেদন করা হবে।

এর আগে গত ২০ নভেম্বর বিকেলে নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর এলাকায় একটি বহুজাতিক কোম্পানির বিক্রয়কর্মী মামুনুর রশিদ ও ১৭ নভেম্বর রাত নয়টার দিকে নওগাঁর শহরের কাঁঠালতলী এলাকায় নওগাঁ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদকে কুপিয়ে হত্যা করে মুখোশধারীরা। ওই দুই ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

জানতে চাইলে নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল বিন আহসান বলেন, ‘নওগাঁয় ঘটে যাওয়া দুটি খুনের ঘটনার সঙ্গে আদমদীঘিতে মৎস্যচাষির ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই ব্যক্তির সংযোগ রয়েছে কি না, আমরা খতিয়ে দেখছি।’

নওগাঁয় গুপ্ত হামলার প্রথম ঘটনা ঘটে জেলার রানীনগর উপজেলায়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাতটার দিকে রানীনগর উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন আমগ্রাম মোড়ে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন আবাদপুকুর বাজারে অবস্থিত নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে কাজ শেষে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে মুখোশধারীরা তাঁর ওপর হামলা চালায়। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি।

গত ১৮ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে আদমদীঘির সান্তাহার পৌরসভার হাটখোলা এলাকায় মুখোশধারীদের হামলায় আহত হন সান্তাহার পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনসুর আলী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মনসুর আলী আদমদীঘি থানায় লিখিত অভিযোগ করলেও বিষয়টি এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত করেনি পুলিশ।

এ বিষয়ে নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানা পুলিশ মামলা নিচ্ছে না—এ বিষয়টি একদম সত্য নয়। বরং আমরাই মামলা নেওয়ার জন্য এবং হামলার বিষয়ে তথ্য জানার জন্য বারবার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সহযোগিতা পাচ্ছি না।’ সর্বশেষ আদমদীঘিতে গ্রেপ্তার দুই হামলাকারীর বিষয়ে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। তাঁরা কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য কি না এবং নওগাঁয় ঘটে যাওয়া গুপ্ত হামলার ঘটনার সঙ্গে তাঁদের নেটওয়ার্ক জড়িত কি না, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।