উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছেলে খুন হয়েছে। ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করছেন মা দিলারা বেগম। স্বজনেরা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। শনিবার দুপুরে শ্রীনগর থানার গোলঘরে
উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছেলে খুন হয়েছে। ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করছেন মা দিলারা বেগম। স্বজনেরা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। শনিবার দুপুরে শ্রীনগর থানার গোলঘরে

উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় হত্যা

‘জানে না মাইরা হাত-পা কাইট্টা দিলেও পোলাডা বাঁইচ্যা থাকত’

‘পোলাডারে কত কষ্ট দিয়া জানি মারছে ওরা! পুকুরঘাটে রক্ত দেইখা বোঝা যায়, পোলাডায় বাঁচার লাইগা অনেক দৌড়াইছে। এরপরও ছাড়ে নাই। কতবার জানি মা মা করছে। ওরা যদি জানে না মাইরা, নীরবের দুইডা হাত-পা কাইট্টা দিত, এরপরও পোলাডায় বাঁইচ্যা থাকত, আমারে মা বইলা ডাকত।’

শনিবার দুপুরে শ্রীনগর থানার গোলঘরে বসে এভাবেই বিলাপ করছিলেন দিলারা বেগম। ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তাঁর ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী নীরব হোসেনকে (১৭) হত্যা করেন স্থানীয় কয়েকজন তরুণ। ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা দিলারা বেগম। থানায় মামলা করতে এসে ছেলের কথা বলতে গিয়ে কয়েকবার জ্ঞান হারান তিনি।

নিহত নীরব হোসেন চাঁদপুরের প্রয়াত দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর শ্রীনগরের ভাগ্যকুল ইউনিয়নের মধ্য কামারগাঁও এলাকায় মা দিলারা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকত। নীরব স্থানীয় কাজী ফজলুল হক উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পরে লৌহজং মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় এবার তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।

দিলারা বেগম বলেন, ‘বিয়ের আট বছর পর কত ওষুধ, কবিরাজ করে নীরবের জন্ম হয়। ও খুব আদরের ছিল। ১৪ বছর আগে নীরবের ছোট ভাইয়ের জন্মের পর ওদের বাবা মারা যায়। এরপর জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে পোলা দুইডারে নিয়ে বাঁইচ্যা আছি। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা, টিউশনি করে নীরবদের পড়াশোনা করিয়েছি। নিজে কষ্ট করেছি, ছেলেদের কোনো কষ্ট করতে দিইনি।’

দিলারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ছেলেটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। বলেছিল, এবার পরীক্ষা শেষে কোথাও কাজ নেবে। সংসারের হাল ধরবে। আমাকে আর কষ্ট করতে দেবে না। অথচ আমারে কষ্টের সাগরে ভাসায়ে চলে গেল। সামান্য একটু প্রতিবাদ করায় দিনের আলোতে নির্মমভাবে ছেলেকে হত্যা করল। এমন ঘটনা যেন কোনো অসহায় মায়ের সঙ্গে আর না ঘটে। যারা নীরবকে হত্যা করছে, আমি তাদের বিচার চাই।’

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার কাজী ফজলুল হক উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে কয়েক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করছিলেন মাগডাল গ্রামের তরুণ আরেফিনসহ আরও কয়েকজন। বিষয়টি দেখে নীরবসহ তিনজন প্রতিবাদ করেন। তখন দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা–হাতাহাতি হলে স্থানীয় লোকজন মীমাংসা করে যার যার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। গতকাল বিকেলে কামারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে বসে ছিলেন নীরবসহ দুজন। বৃহস্পতিবারের ঘটনার জেরে তাঁদের ওপর হামলা করা হয়। এতে নীরবের সঙ্গে থাকা ব্যক্তি পালাতে পারলেও নীরব পালাতে পারেনি। হামলাকারীরা ছুরিকাঘাত করে পাশের একটি খালে ফেলে যায় তাকে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত নীরব হোসেন

সকালে মধ্য কামারগাঁও এলাকায় নীরবের নানাবাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে মাতম চলছে। এলাকার নারীরা জটলা বেঁধে নীরবের স্মৃতিচারণা করছেন। স্বজনেরা নীরবের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

নীরবের নানি মাবিয়া বেগম বলেন, ‘অল্প বয়সে নীরবের মা স্বামীহারা হয়। ছেলেদের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার সংসার করেনি। ফজরের নামাজের পর থেকে টিউশনি, এরপর স্কুল, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত টিউশনি করে ছেলেদের মানুষ করছিল। ওরা আমার নাতিটাকে এভাবে মেরে ফেলল!’

নিহত নীরবের মামা প্রদীপ ব্যাপারী বলেন, ‘নীরব অসম্ভব ভদ্র ছেলে ছিল। কোনো কথা বললে বিনয়ের সঙ্গে মাথা নত করে জবাব দিত। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছিল বখাটেরা। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নীরবকে জীবন দিতে হলো। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি জানাই।’

নীরবের লাশ শুক্রবার রাতে ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। শনিবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের কথা আছে। এ ঘটনায় র‍্যাব ও পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করেছে এবং মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল তায়াবীর।