বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য কুমার নদের একটি বড় অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীপুর উপজেলার সরকারি মহেশ চন্দ্র পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে
বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য কুমার নদের একটি বড় অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীপুর উপজেলার সরকারি মহেশ চন্দ্র পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে

বাসস্ট্যান্ড নির্মাণে নদ ভরাট

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কেউ এই কাজ করলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। কিন্তু মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায় খোদ উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ নদ ভরাট করে এই আইন লঙ্ঘন করেছে। বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ করার জন্য তারা কুমার নদের কিছু অংশ ভরাট করে ফেলেছে। এতে নদে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।

কুমার নদের ভরাট করা এই জায়গাটি উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে সরকারি মহেশ চন্দ্র পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দৈর্ঘ্যে নদের প্রায় দেড় শ ফুট ও প্রস্থে ১২০ ফুট জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ভরাট হওয়া জায়গা ঘেঁষেই গেছে নদের মূল প্রবাহ। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, ওই জায়গাতে বাসস্ট্যান্ড তৈরি করা হলে সাময়িক কিছু সুবিধা হয়তো পাওয়া যাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাসস্ট্যান্ড হলে ভবিষ্যতে ওখানে স্থায়ী যানজটের সৃষ্টি হতে পারে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য কুমার নদের বালু ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে একটি পাকা স্থাপনায় লেখা আছে যাত্রীছাউনি। ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল এই কাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিয়া মাহামুদুল গনি। উদ্বোধনী ফলকে লেখা আছে উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউজিডিপি) আওতায় নির্মিত এই কাজ তত্ত্বাবধান করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা কমলেশ মজুমদার।

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, শ্রীপুর শহরে স্থায়ী কোনো বাসস্ট্যান্ড নেই। উপজেলা শহরের প্রবেশপথে কুমার নদের পাড়ের রাস্তা অস্থায়ীভাবে বাস ও অন্যান্য যানবাহনের স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকাবাসী। ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ২০২০ সালে নদ ভরাট করা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘নদ ভরাট করে বাসস্ট্যান্ড’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই সময় সমালোচনার মুখে নদের আংশিক ভরাট করে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ মিলে ২০২৩ সালের শেষে আবারও বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য নদের বড় একটি অংশ ভরাট করে।

অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০-এর ৬-এর ঙ ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু শ্রীপুরে এই আইন লঙ্ঘন করে বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য কুমার নদ ভরাট করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মমতাজ মহল আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে এ বিষয়ে তাঁর কার্যালয়ের তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে কুমার নদ ভরাট করে বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।

ইউএনও কার্যালয় থেকে পাওয়া ওই তথ্যসূত্রে জানা গেছে, শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ২৬ তারিখে মাসিক সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তৎকালীন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহামুদুল গনি ও ইউএনও কমলেশ মজুমদার স্বাক্ষরিত সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, ভাইস চেয়ারম্যান কাজী জালাল উদ্দীন নদ ভরাট করে বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের প্রস্তাব করেন। তিনি ওই সভায় বলেন, শ্রীপুর সদরে বাস ও টেম্পোস্ট্যান্ডের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। এ কারণে কুমার নদসংলগ্ন রাস্তার ওপর যত্রতত্র যানবাহন পার্কিং করা থাকে। এতে জনগণ চরম ভোগান্তির শিকার হয়।

এই পরিস্থিতিতে সেতুসংলগ্ন রাস্তার ভাঙন প্রতিরোধ করাসহ কুমার নদের গতিপথ ঠিক রাখার স্বার্থে চরপড়া জায়গা থেকে বালু তুলে নদের আংশিক জায়গা বাঁধাই (ভরাট) করে বাসস্ট্যান্ড তৈরি করলে জনগণের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাঘব হবে। ভাইস চেয়ারম্যান কাজী জালাল উদ্দিনের দেওয়া এই প্রস্তাবে সব সদস্য একমত পোষণ করেন। সভায় উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউএনও ও উপজেলা প্রকৌশলীকে। এই কার্যবিবরণীর অনুলিপি মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে গত বুধবার বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিয়াতউল্লাহ হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবু নাসের বেগ লেন, ‘নদ-নদী কিংবা জলমহাল ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। শ্রেণি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশাসনিক অনুমতি প্রয়োজন। শ্রীপুর উপজেলায় একটি বাসস্ট্যান্ড প্রয়োজন, এটা ঠিক আছে। তবে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নদ ভরাট করে অবশ্যই নয়। কেন এটা হচ্ছে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’