অধিক উচ্চতার জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে দেশের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনে বন্য প্রাণীর মৃত্যু ক্রমেই বাড়ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট উঁচু জোয়ারে সুন্দরবনে ৯৬টি হরিণ ও চারটি বন্য শূকর মারা গেছে। বন্য প্রাণীর প্রাণহানির এমন ঘটনা দেশের বনাঞ্চল ও বন্য প্রাণীর জন্য উদ্বেগজনক বলছেন প্রাণী ও দুর্যোগবিশেষজ্ঞরা।
রিমালের তাণ্ডবে এত বন্য প্রাণীর মৃত্যু জলবায়ু–সংকটে অভিঘাত মোকাবিলায় মানুষের পাশাপাশি বন্য প্রাণীরও সুরক্ষা দরকার—কথাটিই জানান দিয়ে গেল। এ ব্যাপারে শিগগির উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিলেন দুর্যোগবিশেষজ্ঞরা। বললেন, জোয়ার মোকাবিলায় সুন্দরবন ও অন্য বনাঞ্চলের ভেতরে প্রাণীদের আশ্রয়ের জন্য উঁচু ডিবি তৈরির পাশাপাশি মিঠাপানি, খাবারের সংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হানে গত রোববার রাতে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ছিল প্রায় ৪০ ঘণ্টা। স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ারে প্লাবিত হয় সুন্দরবন; যা বন্য প্রাণীর জন্য ছিল অসহনীয় এবং টিকে থাকার জন্য দুরূহ।
জলোচ্ছ্বাসে আরও অনেক বন্য প্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ বাঘ জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ ও ফলাফল তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, উপকূলীয় এলাকা উঁচু জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এতে বন্য প্রাণী বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এবার কী পরিমাণ বন্য প্রাণী মারা গেল, কী পরিমাণ আহত হলো, তাদের বয়স কেমন, লিঙ্গ কী—এসব নিয়ে জরিপ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে হরিণ খুবই সংবেদনশীল প্রাণী। একই সঙ্গে বাঘের অবস্থা কেমন, সেটাও জানা দরকার।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ক্ষত সামনে আসছে। গত বুধবার পশ্চিম সুন্দরবনের বজবজা, শাকবাড়িয়া ও কাশিয়াবাদ এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছের ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সুন্দরবনের বস্টুমখালী খালের মুখে ভেঙে পড়ে আছে বিরাট এক গেওয়াগাছের ডাল।
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার বললেন, বাতাসের চেয়ে ডুবে থাকা বনভূমি প্রাণীর জন্য বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। ঝড়ের পর আর আগের মতো পাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাণী বা বনের ক্ষতির সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। কারণ, সাড়ে ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বনের অনেক অংশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনের ১১ বর্গকিলোমিটার গোলপাতা বাগান। পাড় ভেঙে লোনাপানি ঢুকেছে বনের ৫০টি পুকুরে। বন্য প্রাণীগুলো এসব পুকুরের মিঠাপানি পান করত।
বন্য প্রাণীদের এমন বিপদে পড়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ২০২১ সালের আরেক ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় এমন ঘটনা ঘটেছিল। ২০২১ সালের ২৬ মে ভারতের ওডিশায় আঘাত হানে ইয়াস। এর আগের দিন রাতের কথা। বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি, সঙ্গে বাতাস। জোয়ারের তোড় থেকে রক্ষা পেতে সুন্দরবনের দুবলা জেলেপল্লি টহল ফাঁড়ির বনকর্মীরা আগেই আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে। হঠাৎ আশ্রয়কেন্দ্রের নিচে ছোট্ট এক শাবককে নিয়ে সাঁতরে এসে উঠল দুটি চিত্রল হরিণ। তখন থরথর করে কাঁপছিল শাবকটি। মা হরিণটিও ছিল সন্ত্রস্ত। তবু শাবকটিকে পরম মমতায় গা চেটে দিচ্ছিল। ওই দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেছিলেন এক বনরক্ষী।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৭ সালে সিডরের পর সুন্দরবনে ৪০টি হরিণ, ১টি বাঘ ও ১টি তিমির মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০০৯-এ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর তিনটি হরিণ ও ১টি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হওয়া ঝড়গুলোতে বাঘ, হরিণসহ অন্য কোনো বন্য প্রাণীর ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে চারটি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আর সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯৬টি হরিণ ও চারটি বন্য শূকরের মরদেহ পাওয়া গেছে।
নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক উচ্চতার জোয়ারের এই প্রবণতার শুরু ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, সিডরে জোয়ারের উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে ১২ ফুট। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় প্রায় ৯ দশমিক ৩৪ ফুট উচ্চতার জোয়ার হয়। ২০১৩ সালের ১৬ মের ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে জোয়ারের তীব্রতা ছিল সাড়ে ৯ ফুট। ২০১৫ সালে ঘূর্ণিঝড় কোমেন, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৯-এ ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুলের প্রভাবে ১০ থেকে ১২ ফুটের জোয়ারে প্লাবিত হয়। ২০২১ সালে ইয়াসের প্রভাবে ৮ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতার জোয়ার হয়। আর সর্বশেষ রিমালে ১০–১২ ফুট অধিক উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হয় সুন্দরবন। অথচ সিডরের আগে দক্ষিণ উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা কখনোই সাড়ে ৯ ফুটের বেশি দেখা যায়নি।
বন্য প্রাণীদের এমন বিপদ থেকে রক্ষায় কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—এ নিয়ে কথা হয় বন্য প্রাণীবিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব অভিঘাত রয়েছে, সেগুলো মাথায় রেখেই সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা নিতে হবে।’ তাঁর মতে, সুন্দরবনের ভেতরে যে পুকুরগুলো আছে, সেগুলোতে এখন লোনাপানি ঢুকে গেছে। সেগুলো দ্রুত সেচ করা দরকার। সামনে বর্ষা মৌসুম এ জন্য দ্রুত সেখানে মিঠাপানির সংস্থান হবে।
সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণে একটি প্রকল্পের আওতায় কিছু মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছিল; সেই প্রকল্প এখনো চলমান আছে উল্লেখ করে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনে ১২টি উঁচু কিল্লা রয়েছে। তবে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন দুর্যোগ আসছে। তাই এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাণীদের সংরক্ষণে আরও কী কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে ভাবা হবে।