একসময় কুচো চিংড়ি বা ছোট চিংড়ির দাম কম ছিল। এখন দিন বদলে গেছে, এসব চিংড়ি এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য, ফলে দামও অনেক বেশি। এসব চিংড়ি ধরে ও বিক্রি করে হাওরাঞ্চলের নিম্নবিত্ত লোকজন জীবিকা নির্বাহ করেন। আগের মতো চিংড়ি পাওয়া না যাওয়ায় তাঁদের জীবিকায় টান পড়েছে। তাঁরা আছেন বিপাকে।
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাউয়াদিঘি হাওর থেকে এসব চিংড়ি ধরার কাজ করেন স্থানীয় নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন। চিংড়ি ধরে হাটবাজারে বিক্রি করেই চলে তাঁদের সংসার। বর্ষাকালে হাওরের পানিতে তুলনামূলক বেশি চিংড়ি পাওয়া যায়। ফলে এ সময় তাঁদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তবে এবার আগের মতো চিংড়ি ধরা না পড়ায় জীবিকার সংকট তৈরি হয়েছে তাঁদের।
২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে কাউয়াদিঘি হাওরপাড়ের অন্তেহরি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, হাওরের অল্প পানিতে ভাসছে তিনটি নৌকা। প্রতিটি নৌকায় অসংখ্য ছোট পট (পাত্র), যা স্তূপ করে রাখা। এসব পাত্র স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘কিরণমালা’ নামে পরিচিত। এগুলো প্লাস্টিক ও বাঁশ-বেতের তৈরি। একটি নৌকায় লোক নেই। দুটি নৌকার লোকজন পাত্রে সিঁদলের (শুঁটকি) টুকরা ভরছেন। পাত্রে সিঁদল ভরার পর পাত্রটি লম্বা সুতায় বেঁধে নেওয়া হয়। জালের সঙ্গে বিশেষ কায়দার সেই পাত্র পানিতে ফেলা হয়। পাত্রের সিঁদল খেতে এসে আটকা পড়ে চিংড়ির ঝাঁক।
পটের মধ্যে সিঁদল দেই। সিঁদলের গন্ধে পটের মধ্যে চিংড়ি মাছ এসে ঢুকে। পানি কম থাকায় মাছও মারতাম (ধরতে) পারছি না। তারপরও এই কাজই করি।সঞ্জয় বিশ্বাস, জেলে
অন্তেহরি গ্রামের জেলে সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, বিকেল হলে তাঁরা পাত্রগুলো সিঁদল দিয়ে প্রস্তুত করেন। পরে নৌকা ভাসিয়ে কাউয়াদিঘি হাওরের মাঝখানে চলে যান। হাওরের গভীর পানিতে এসব পাত্র জলের মধ্যে ডুবিয়ে তারপর হাওর থেকে ফিরে আসেন। সারা রাত সুতায় বাঁধা এসব পাত্র হাওরের পানিতেই তলিয়ে থাকে। পরদিন সকালে গিয়ে পাত্রগুলো তুলে নিয়ে এলে দেখা যায় কুচো বা ছোট চিংড়ি ধরা পড়েছে। তাঁদের নৌকায় এ রকম ৪০০টি পাত্র আছে।
সঞ্জয় বিশ্বাস ও তাঁর বাবা মাখন বিশ্বাস অনেক দিন ধরে এভাবে চিংড়ি ধরার কাজ করছেন। সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘পটের মধ্যে সিঁদল দেই। সিঁদলের গন্ধে পটের মধ্যে চিংড়ি মাছ এসে ঢুকে। পানি কম থাকায় মাছও মারতাম (ধরতে) পারছি না। তারপরও এই কাজই করি।’
পাশেই আরেকটি নৌকার মধ্যে ‘কিরণমালা’ প্রস্তুত করছিলেন আরও তিনজন। তারাও জানালেন, এবার হাওরে তেমন চিংড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চিংড়ি ধরে মনে আনন্দ পাচ্ছেন না।
পাত্রে সিঁদল ঢোকানোর কাজ করছিলেন হাওরপাড়ের কাদিপুর গ্রামের গৌরমনি বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার একবারে মরাত (মাছ কম মিলছে)। একবারেই মাছ লাগইন না (ধরা পড়ে না)। অন্যবার ভালাই পাইছি। দুই-তিন শ টাকা খরচ অই যায়গি (হয়ে যায়)। তাই পাঁচ-ছয় শ ট্যাকার মাছ পাইয়া পোষায় না। চিংড়ি মাছ ছাড়া আর কুনতা ধরি না।’
অন্তেহরি ও কাদিপুর গ্রামে ১০–১২টি নৌকা আছে। প্রতিটি নৌকায় একেকটি পরিবারের সদস্যরা মিলে চিংড়ি ধরে থাকেন।
এবার এত কম চিংড়ি ধরার পড়ার কারণ বুঝতে পাচ্ছেন না গৌরমনি বিশ্বাস। তাঁর ধারণা, এবার দেরিতে হাওরে পানি এসেছে। ফলে চিংড়ি সঠিক সময়ে ডিম ছাড়তে পারেনি।
চিংড়িশিকারিরা বলছেন, অন্তেহরি ও কাদিপুর গ্রামে ১০–১২টি নৌকা আছে। প্রতিটি নৌকায় একেকটি পরিবারের সদস্যরা মিলে চিংড়ি ধরে থাকেন। এবার চিংড়ি কম ধরায় পড়ায় ১০ থেকে ১২টি পরিবার জীবিকার সংকটের মধ্যে আছে।