নিজ এলাকায় ঠিকমতো কাজ পাওয়া যায় না। মজুরিও কম। তাই পরিবারের অভাব-অনটন মেটাতে কাজের সন্ধানে নিজের জেলা ছেড়ে ফেনী শহরে আসেন শ্রমিকেরা। শহরের ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্বর থেকে খেজুরগাছ গোলচত্বর পর্যন্ত প্রতিদিন জড়ো হন কয়েক শ শ্রমিক। কাজ পেলে যা আয় হয়, তা দিয়েই বাসাভাড়া ও সংসার চালান তাঁরা।
এমন এক শ্রমিক সিরাজুল ইসলাম। তিনি রংপুরের বাসিন্দা। কাজের সন্ধানে স্ত্রী-সন্তানসহ ফেনীতে থাকেন। ছয় বছর ধরে নিয়মিত ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে শ্রমের হাটে আসেন। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ছয় বছর ধরে এই হাটে তাঁরা শ্রম বিক্রির জন্য আসেন। কৃষিজমি পরিষ্কার, মাটি কাটা, নতুন সড়ক নির্মাণ, পরিত্যক্ত দালান, ব্রিজ ও কালভার্ট ভাঙা, ধান রোপণ, আলু, ভুট্টা, তরমুজ লাগানোসহ চুক্তিতে সব ধরনের কৃষিকাজ করেন। ছয়-আট মাস চলে তাঁদের কাজ। যে টাকা আয় হয়, সেটা দিয়ে বাসাভাড়া ও সারা বছর সংসার চালান তাঁরা।
সিরাজুলের মতো এমন দুই থেকে তিন শ নারী ও পুরুষ শ্রমিক এখানে আসেন কাজের সন্ধানে। তাঁদের কারও বাড়ি উত্তরাঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুরে। কারও বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট, যশোর। নরসিংদী, কুমিল্লার শ্রমিকদেরও পাওয়া যায় এখানে।
গত বুধবার সকালে ফেনী শহরের জিরোপয়েন্ট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শহরের দোয়েল চত্বর থেকে খেজুর চত্বর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০ জন শ্রমিক। কেউ সারিবদ্ধভাবে, আবার কেউ এলোমেলোভাবে বসে ও দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী। স্থানীয় কৃষকেরা এসব শ্রমিকের মধ্য থেকে দরদাম করে জমিসহ বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক শ্রমিক দিন চুক্তিতে কাঙ্ক্ষিত মূল্যে কাজ করতে দর-কষাকষি করছেন।
জেলার সোনাগাজী উপজেলার চর চান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চর চান্দিয়া গ্রাম থেকে শ্রমিক নিতে এসেছেন মো. রুবেল। তিনি বলেন, ভুট্টার জমি প্রস্তুত ও রোপণ করার জন্য ১০০ থেকে ১২০ শ্রমিক দরকার। একসঙ্গে এত শ্রমিক শুধু এই হাটেই পাওয়া যায়। দিনপ্রতি ৪০০-৭০০ টাকা পারিশ্রমিকে একেকজন শ্রমিক পাওয়া যায়। তাই গত তিন বছর ধরে ২৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই হাটে এসে শ্রমিক নিয়ে যান তিনি।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসী–অধ্যুষিত জেলা ফেনীর প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন কাজের জন্য প্রতিনিয়ত প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রতিবছর কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে আলু, ভুট্টা, সূর্যমূখী, শর্ষেসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শর্ষে ও ভুট্টার আবাদ হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবাদ ও ফসল তুলতে হয়। এ জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। তবে ফেনীতে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা অনেক কম। আর উত্তরাঞ্চলের মানুষের ছিল কাজের অভাব।
স্থানীয় লোকজন জানান, বছর দশেক আগে উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকেরা শ্রম বিক্রির জন্য এদিকে আসতে শুরু করেন। প্রথম দিকে অল্প কিছুসংখ্যক শ্রমিক এখানে আসতেন। পরে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ বছর আগের চেয়ে এই সংখ্যা বেড়ে দুই থেকে তিন হাজার হয়ে যায়। তবে কৃষিজমি ও কাজ কমতে শুরু করায় হাটে শ্রমিক আসা কমে গেছে। এখন ৭০০ থেকে ৮০০ শ্রমিক প্রতিদিন এখানে শ্রম বিক্রি করতে আসেন।
কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর অক্টোবর থেকে পরবর্তী বছরের মে মাস পর্যন্ত তাঁদের কাজের চাহিদা থাকে। এ সময় তাঁরা জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে কম দামে অনেকে মিলে একসঙ্গে বাসা ভাড়া করেন। আবার কেউ কেউ আশপাশের খুপরি, স্কুলের বারান্দা ও রেললাইনের পাশে অস্থায়ী বসতি করে থাকেন। কাজ শেষ করে অনেকে ফেনী থেকে নিজ এলাকায় ফিরে যান। কেউ কেউ আবার নিজেকে অন্য কাজে লাগিয়ে এখান থেকে চলে যান।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা তরিকতের নেছা বলেন, সবকিছুর দাম বেশি। পেটের দায়ে কাজ করতে ফেনীতে এসেছেন। এখানেও কাজের চাহিদা কমে গেছে। গত বছর দিনভিত্তিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পেলেও এবার ৪০০ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। কাজ সমান হলেও পুরুষের চেয়ে নারীদের মজুরি কম দেওয়া হয়।
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর এলাকার বাসিন্দা সফিক মিয়া স্ত্রী, দুই ছেলেসহ ফেনীতে কাজের সন্ধানে এসেছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে তাঁরা শ্রম বিক্রির হাটে এসে বসে থাকেন। ছেলেরা সব সময় কাজ পেলেও বয়স বাড়ায় তিনি ও স্ত্রী কখনো কাজ পান, কখনো পান না। কাজ না পেলে বাসায় গিয়ে ছেলেদের জন্য স্ত্রী ভাত রান্না করেন। তিনি স্ত্রীকে সাহায্য করেন।