বাক্প্রতিবন্ধী সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে না পেরে নিজেই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন রিকতা আখতার বানু। এ কাজে জমি দান করেন তাঁর স্বামী। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দেবরসহ আরও কয়েকজন। দোচলা টিনের ঘর তুলে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলেও প্রথম বছরেই পেয়ে যান ৬৩ জন শিক্ষার্থী। ধীরে ধীরে গত ১৫ বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে ২৯৪ জনে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামে শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন তিনি।
রিকতা আখতার বানু কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে তাঁর এই সংগ্রামের কারণে বিবিসির ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ২০২৪ সালের এই তালিকা গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে বিবিসি।
রিকতা আখতার চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের রমনার সরকার বাড়ি এলাকার বাসিন্দা। বিবিসির অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে জায়গা পাওয়ায় তাকে নিয়ে যখন দেশ-বিদেশে আলোচনা চলছে তখন রিকতা আখতার বানু স্বপ্ন দেখছেন তাঁর বিদ্যালয়টি একদিন আবাসিক হবে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তিনি বিদ্যালয়েই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
রিকতা আখতার বানু প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের বৈষম্যের চোখে দেখা হয়। সমাজ থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য যেদিন শেষ হবে; এসব শিশুরা যেদিন স্বাভাবিকভাবে সমাজের সবার সঙ্গে হাসিমুখে চলাফেরা করার সুযোগ পাবে সেদিন একজন প্রতিবন্ধী শিশুর মা হিসাবে আমার যুদ্ধের শেষ হবে।’
গতকাল মঙ্গলবার চিলমারী উপজেলার রমনায় রিকতা আখতার বানু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নানা কৌশলে পড়ালেখা করাচ্ছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২১ জন শিক্ষক। সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে শিশুদের নানা ধরনের শরীরচর্চাও করানো হয়।
কথায় কথায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্প বলেন রিকতা আখতার বানু। তিনি জানান, তাঁর মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মনি একজন বাকপ্রতিবন্ধী। ২০০৮ সালে তাকে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। কিন্তু কিছুদিন পরে শিক্ষকেরা প্রতিবন্ধী শিশুকে পড়াবেন না বলে স্কুল থেকে তাকে বের করে দেন। অনেক অনুরোধেও তিনি সেখানে আর মেয়েকে পড়ানোর অনুমতি পাননি।
রিকতা আখতার বলেন, ‘আমার মেয়ের সাথের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়া দেখে সে কান্নাকাটি কারত। নিজেই নিজের হাত-পায়ে কামড় দিত। পরে মেয়ে ও সমাজের অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুল চালু করি।’
তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয় শুরুর প্রথম বছরে উপজেলার ৬৩ জন প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তি হয়। এ কাজে তাঁর স্বামী ২৬ শতক জমি দাম করেন। ওই জমিতে দোচালা টিনের ঘর নির্মাণ করে বিদ্যালয় শুরু করেন। কিন্তু বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষক পাওয়া। এসব প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ পড়াতে চাইতেন না। পরে তাঁর ব্যাকুলতা দেখে দেবর পড়াতে রাজি হন। একে একে আরও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় শুরু করেন। বর্তমানে এই প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২৯৪ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।
শুরুর দিকে রিকতা আখতার বানু সংসারের খরচ বাঁচিয়ে এসব শিশুদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করতেন। ২০২০ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হলে শিক্ষক-কর্মকচারীরাও রিকতা আখতারকে শিশুদের নাশতার খরচে কিছুটা সহযোগিতা করেন।
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহীন শাহ প্রথম আলোকে বলেন, এই বিদ্যালয়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের শিশুরা পড়ালেখা করে। কেউ কেউ পাঁচ–ছয় কিলোমিটার দূর থেকে পড়তে আসে। তাদের আনা–নেওয়ার জন্য জন্য তিনটি ভ্যানগাড়িও রয়েছে।
শাহীন শাহ বলেন, এসব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য খেলার সামগ্রী এবং আরও কিছু সরঞ্জাম দরকার। এখানে বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেওয়া হলেও এদের একীভূত শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নিতে সমস্যা হবে। তাই কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
রিকতা আখতার বানু সম্পর্কে বিবিসি বলেছে, তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করেন। সেখানে অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক বা শেখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন স্কুলটি বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থাকা শিশুশিক্ষার্থীদের সেবা দিয়ে থাকে।