ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার সাভারে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এরই মধ্যে শিল্পকারখানার ঝুটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা দখল, জমি দখল, চাঁদাবাজির মতো কর্মকাণ্ডে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে চলে যান। অন্যদিকে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। ৬ আগস্ট থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা মহড়া দিচ্ছেন, পথসভা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে আসায় অনেকে খুশি হয়েছিলেন। তবে এরই মধ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তাঁদের অনেকে। ফলে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে মানুষের ক্ষোভও বাড়ছে।
শিল্প এলাকা সাভারে লোভনীয় একটি ব্যবসা তৈরি পোশাক কারখানার উচ্ছিষ্ট কাপড়ের (ঝুট) ব্যবসা। ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই সাধারণত এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে কারখানাগুলোয় ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-পরিবার কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বাবু এবং ঢাকা জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব খানের অনুসারীরা ঝুট ব্যবসা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কারখানার ব্যবসা দখলে নিয়েছেন।
আশুলিয়ার বারইপাড়ায় রোজ ইন্টিগ্রেটসের ঝুট ব্যবসা দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সালাউদ্দিন বাবু ও আইয়ুব খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত শিমুলিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রুবেল শেখ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্য মো. শামীম, যুবদলকর্মী নূর ইসলামের বিরুদ্ধে। তাঁরা একই এলাকার তানজিলা টেক্সটাইল লিমিটেডের ঝুট ব্যবসাও দখলে নিয়েছেন। এ ছাড়া কবিরপুরে ইউরো আর্তে অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের কারখানার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রোজ ইন্টিগ্রেটসের ঝুট ব্যবসার মালিকানা দাবি করে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘চুক্তি থাকলেও ব্যবসা করতে পারিনি। এখন রুবেল, শামীমসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসাটি নিজেদের দখলে নিয়েছেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তানজিলা টেক্সটাইলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এক ঝুট ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বছরের জন্য আমিসহ আরও দুজনের সঙ্গে ঝুটের ব্যবসা নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়। তবে কিছুদিন আগে রুবেল, শামীমসহ কয়েকজন ঝুট বের করে ফেলেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রুবেলের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। মো. শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রুবেল মামা তানজিলা ফ্যাক্টরি থেকে ঝুট বের করেছে। আমি অন্য ফ্যাক্টরি থেকে বের করি।’
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ক্ষমতার পালাবদলের পর বিএনপির নেতারা বিভিন্ন কারখানায় ঝুট ব্যবসা দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে শুনেছেন। বিভিন্ন কারখানার শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফোন করে ঝুট ব্যবসা তাঁদের লোকজনকে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
সাভারের বিভিন্ন এলাকার ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশাপাশি চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। সাভারের ইসলামনগরে ডিশ ব্যবসা করে আসছিলেন শামসুল হক নামের এক ব্যক্তি। তিনি অভিযোগ করেন, ৬ আগস্ট পাথালিয়া ইউনিয়ন যুবদলের নেতা ইকবাল কবির, আহসানুল্লাহসহ নেতা-কর্মীরা তাঁর প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপর থেকে বিলও তাঁরাই তুলছেন। ১৩ আগস্ট কবির মুঠোফোনে তাঁকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে ইকবাল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে ডিশের ব্যবসাটি শুরু করেন খোকন। ২০১৫ সালের দিকে ব্যবসাটি শামসুল হক দখলে নিয়ে নেন। সম্প্রতি খোকন ব্যবসাটি ফিরে পেতে সহায়তা চাইলে তাঁকে সহায়তা করেছেন।
সাভারের ছোট বলিমেহের মৌজায় সফুরা বেগম ও রোকেয়া বেগমের কাছ থেকে ২০১০ সালে ৫ শতক ও ২০১২ সালে ৫ শতক জমি কেনেন আবুল কালাম আজাদ, জিয়াউল ইসলাম ও ফিরোজা বেগম নামের তিনজন। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ওই জমির খাজনা, পৌর কর, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল পরিশোধ করছেন তাঁরা। ২০২১ সালে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের কাছ থেকে নকশা অনুমোদনও পেয়েছেন। ক্ষমতা পালাবদলের পর ধামরাই পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মো. মাছুম আহম্মেদসহ আগের মালিকদের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ওই জমির সীমানাদেয়ালের ফটকের তালা ভেঙে ফেলেছেন। সর্বশেষ ১৮ আগস্ট টিনের একটি ছাপরাঘর তুলে জমি দখলের চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে মো. মাছুম আহম্মেদ বলেন, সফুরা ও রোকেয়ার আপন ভাই নাজির হোসেন ও রফিকুল ইসলাম। নাজির হোসেন সম্পর্কে তাঁর শ্বশুর হন। নাজির হোসেন জায়গা বিক্রি করেননি। যাঁরা কিনেছেন তাঁরা বৈধভাবে জমি কেনেননি। তিনি উভয় পক্ষকে একসঙ্গে বসে বৈধ কাগজপত্র দেখে সমস্যা সমাধানের জন্য বলেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ আগস্ট আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় একটি ঝুটের গুদামে চাঁদা চাইতে লোকজন নিয়ে যান মো. মাছু নামের এক ব্যক্তি। বিষয়টি জানতে পেরে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা মাছুর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। মাছু নিজেকে সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন বাবুর চাচাতো ভাই পরিচয় দিয়ে গুদামমালিকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে দেওয়ার আবদার করেন। পরে ওই নেতা গুদামমালিককে টাকা দেওয়ার বিষয়ে বলবেন জানালে সমস্যার সমাধান হয়।
এসব বিষয়ে সালাউদ্দিন বাবু ও আইয়ুব খানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁরা ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিএনপির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বহু জায়গা থেকেই অভিযোগ পাচ্ছেন। সেগুলো যাচাই–বাছাই করে সত্যতা পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্দেশনা দিয়েছেন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যে বা যাঁরাই জড়িত থাকবেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেতা-কর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় বিএনপির অনেকেই এসব বিষয় নিয়ে বেশ বিব্রত। ১৬ বছর মাঠে থাকা নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করে গুটিকয়েক নেতা-কর্মী দলে অনুপ্রবেশকারীদের পুনর্বাসনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।