সকালে অতিথিদের আপ্যায়নে ছিল খেজুরের রস। পরে চা, তা–ও খেজুরের গুড়ের। ভাত খাওয়ার পর ডেজার্ট হিসেবে ছিল ঘ্রাণ ছড়ানো নতুন খেজুরের গুড়। শেষ আকর্ষণ ছিল খেজুর রসের হাঁড়ি ভাঙা। পুরস্কার ছিল খেজুরপাতার শীতলপাটি। ছবি তোলার ফ্রেম বানানো হয়েছিল খেজুরপাতা দিয়েই। এই আয়োজন ছিল দেশের খেজুর গুড় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের প্রথম সম্মেলনে। রাজশাহীর দুর্গাপুরের এক খেজুরবাগানে শনিবার দিনব্যাপী এই আয়োজনে যোগ দেন সারা দেশের ১৬০ জন খেজুর গুড়চাষি ও ব্যবসায়ী। সম্মেলনের স্লোগান ছিল ‘ঐতিহ্যের পথে প্রজন্মের সাথে’। আলোচনায় ঠাঁই পায় মানসম্মত খেজুর গুড় উৎপাদন ও বিপণনপ্রক্রিয়া এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সম্পর্কে জানা। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ‘গুড় ব্যাপারীদের আড্ডাখানা’ নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম।
ব্যতিক্রমী এই সম্মেলনে যাঁরা আসেন, তাঁদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন বা করছেন। তাঁরা চাকরির দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থান।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা ইউনিয়নের ছত্রাগাছা গ্রামের রাস্তা দিয়ে মাঠের দিকে যেতেই চোখে পড়ল খেজুরগাছের সঙ্গে হেলান দেওয়া একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে, ‘খেজুর গুড় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের প্রথম সম্মেলন-২০২৪।’ তাতে তিরচিহ্ন দিয়ে পথ দেখানো রয়েছে। হাতের ডান পাশে এক সারি খেজুরগাছ, বাঁ পাশে বড় একটি পুকুর। মাঝখানে সরু পথ চলে গেছে ওই খেজুরবাগানের দিকে। দুই মিনিটের পথ টেনে নিয়ে গেল সেই বাগানে। সেখানেই শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। বাগানের উত্তর পাশে মরিচখেত, পশ্চিম পাশে লাউমাচা, পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে খেজুরগাছের সারি। মাঝখানে মঞ্চ।
একটি নালা টপকে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতেই ছবি তোলার ফ্রেম। খেজুরপাতার ফ্রেমে একে একে সবাই মাথা ঢোকাতে লাগলেন। পাশেই সকালের তাজা খেজুরের রস। তবে একজন এক কাপের বেশি নয়। অবশ্য খেজুর গুড়ের চা যে যতবার পারছেন, পেয়ালায় ভরছেন।
এর মধ্যে শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। মঞ্চে বসলেন চাঁপাই আমবাগানের স্বত্বাধিকারী শাহাবুদ্দীন। এ আয়োজনের গোড়ার কথা শোনালেন দুর্গাপুরের পল্লী খাবারের মো. সাদিকুর রহমান। তিনি অর্গানিক পণ্য উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, অনলাইন ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে গ্রুপ আছে কিন্তু; গুড় নিয়ে গ্রুপ নেই। তিনি এই গ্রুপ গঠনের জন্য তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে ডাক দেন। প্রথমে ১৭ জন চাষি ও ব্যবসায়ী সাড়া দেন। দুই মাসের মাথায় সারা দেশের ৩০০ জনের বেশি যুক্ত হন এই গ্রুপে।
তাঁর কথায় বোঝা গেল, দেশে খেজুর গুড়ের খ্যাতির শীর্ষে যশোর জেলার অবস্থান। সেই গুড়ের সম্মেলন কেন রাজশাহীতে আয়োজন করা হলো। কারণ, রাজশাহীর ছেলে সাদিকুর এর স্বপ্নদ্রষ্টা।
অনুষ্ঠানে খেজুর গুড়ের ইতিবাচক–নেতিবাচক প্রচার নিয়ে কথা বললেন আল মদিনা হানি অ্যাগ্রো এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আকমল হোসেন মাহমুদ। নাটোরের তাহমিনুর রহমান বললেন, আইনের ভাষায় ভেজাল খাদ্য কী, ভেজাল প্রমাণ হলে কী শাস্তি হতে পারে, খেজুর গুড় উৎপাদন ও বিপণনকারীদের কী সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত। গুড়ের গুণগত মান ঠিক রাখার প্রক্রিয়া নিয়ে বললেন পালকি ফুড লিমিটেডের সারোয়ার জাহান। তাঁর কথা, গুড় ভালো করতে হলে ভালো গাছ, ভালো গাছি লাগবে। তিনি বলেন, ‘ইউরোপে গুড়ের চকলেটের চাহিদা রয়েছে। আমরা করতে পারলে এই গুড়কে ঘিরে দেশে শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে পারে।’
স্বাদের ভুবনের স্বত্বাধিকারী তরিকুল ইসলাম বলেন, খেজুর গুড়ের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল। অনেক খেজুরগাছ কাটা পড়ছিল। বিগত কয়েক বছরে অনলাইন উদ্যোক্তাদের কারণে খেজুর গুড়ের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। যে কারণে চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। নতুন করে খেজুরগাছ রোপণ হচ্ছে।
সম্মেলনে গুড়ের শক্ত বা নরম অবস্থা, গুড়ের তিতকুটে স্বাদ, গুড়ের প্রাকৃতিক অ্যাসিডিক বৈশিষ্ট্য, সংরক্ষণের নিয়ম, দুধের ছানা কেন কাটে, দুধে গুড় মেশানোর নিয়ম নিয়ে সবার জন্য প্রচারপত্র তৈরি করা হয়।
শেষ পর্ব ছিল রসের হাঁড়িভাঙা খেলা। চোখবাঁধা অবস্থায় হাঁড়ি ভেঙে পুরস্কার জিতে নেন ফেনীর মহিপালের ইফাত হোসেন, মাদারীপুরের শাহিন ও নাটোরের মো. ইব্রাহিম। হাঁড়িতে বাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রস যেভাবে ছিটকে পড়ে, উপস্থিত সবার উচ্ছ্বাস ছিল ঠিক তেমনই।
এ সম্মেলনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল ডেজার্ট আইটেম। খাওয়াদাওয়া শেষে ঝিনাইদহের লিখন আহমেদ একটি বাটিতে সেখানকার নতুন খেজুরের গুড় আর চামচ নিয়ে ঘুরছেন। সবাই তাঁর কাছ থেকে এক চামচ করে গুড় মুখে দিচ্ছেন। আর কেউ কেউ সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পের সেই বড়কর্তার মতো চোখ বন্ধ করে যেন স্বাদ নিচ্ছিলেন।