বিএনপির দলছুট নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে অবাঞ্ছিত ও প্রতিহত করার পাশাপাশি এ আসনের উপনির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। চলতি মাসের শুরুতে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দিলেও মাঠে নেই সরাইল উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। নির্বাচন বর্জনের কোনো প্রচারণাও তাঁরা করছেন না। অনেকে এলাকাও ছেড়েছেন।
তবে সরাইলে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে ‘সাত্তারপন্থী’ হিসেবে পরিচিত পদবঞ্চিত ব্যক্তিরা আছেন আগের মতোই। তাঁদের অনেকেই প্রকাশ্যে ও গোপনে সাত্তারের পক্ষে কাজ করছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর ২৯ ডিসেম্বর তিনি দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ ছাড়েন। ১ জানুয়ারি একই আসনে উপনির্বাচন করার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। এ জন্য ওই দিন রাতেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে দলীয় সব পদ থেকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
এরপর ২ জানুয়ারি উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা সরাইল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সরাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তাঁরা সাত্তারকে ‘মীর জাফর ও বেইমান’ আখ্যা দিয়ে প্রতিহত করার ঘোষণাও দেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি। এটি সাত্তারের ব্যক্তিগত ঘাঁটি নয়। আমরা তাঁকে প্রতিহত করব। যদি দলীয় কোনো নেতা-কর্মী তাঁকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা তাঁকে বয়কট করলাম।’
আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিছুল ইসলাম ঠাকুর, সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লস্কর, সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল মাহমুদ আলী, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান সিদ্দিকী, সদস্যসচিব নূর আলম, উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জামাল হোসেন লস্কর, সদস্যসচিব মীর ওয়ালিদ প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন করে সাত্তারকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিন পর থেকে তাঁরা নিজেরাই রাজনীতির মাঠ ছাড়তে থাকেন। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে অনেকে এলাকাও ছেড়েছেন।
বিএনপির পদধারীরা সাত্তারের বিরুদ্ধে হলেও পদবঞ্চিতরা পাশে
সরাইলের চলমান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার নির্বাচনী কার্যক্রম ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদের নেতা-কর্মীরা মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সরাইল উপজেলা সদরে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতা-কর্মীকে তেমন দেখা যাচ্ছে না। এমনকি সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডেও তাঁদের দেখা মিলছে না। অধিকাংশ সময় তাঁদের মুঠোফোন বন্ধ থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁদের সাত্তারবিরোধী কিংবা নির্বাচন বিরোধী প্রচারণাও থেমে গেছে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই প্রত্যক্ষভাবে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সহায়তা করছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাদেকুর রহমান, সাবেক সদস্য উপজেলা জিয়া মঞ্চের সভাপতি এম কামাল হক, উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সদর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার এবং উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক রিফাত বিন জিয়া। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সাবেক অনেক নেতা-কর্মীই পরোক্ষভাবে সাত্তারকে সহায়তা করছেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকায়, উপজেলা সদরে ও গ্রামের বাড়িকে গিয়ে কুশল বিনিময় করছেন। সাত্তারের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেওয়ায় দল থেকে এখন পর্যন্ত বহিষ্কৃত হয়েছেন সাদেকুর রহমান ও এম কামাল হক।
দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে তিনি জাগদলের (জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭৯ সালে কুমিল্লা-১ (নাসিরনগর ও সরাইলের একাংশ) আসনের নির্বাচনে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। ওই বছর তিনি হুক্কা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তখন তিনি দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। এরপর বিএনপিতে ফিরে যান। দলে ফিরে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। একবার টেকনোক্র্যাট প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর স্বজনেরা বলে থাকেন, তিনি জীবনের প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আর শেষ নির্বাচনও করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া টানা ২৭ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও ২ বছর সরাইল উপজেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই ছিলেন সরাইল উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা।
আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার ছেলে মাঈনুল হাসান ভূঁইয়া একাধিকবার তাঁর বাবার দলত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, কয়েক বছর ধরে তাঁর বাবাকে দলীয় কোনো বিষয়েই জানানো হয় না। জেলা বা নিজের উপজেলা কমিটি গঠনের বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া হয় না। দলীয় সব বিষয়ে তাঁর বাবাকে কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয়ভাবে অবজ্ঞা ও অবমূল্যায়ন করা হচ্ছিল। এ জন্য দল থেকে তাঁর বাবা পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া নিজেও ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন বিএনপি করলাম। এখন যদি মানসম্মান না থাকে, দল করব কীভাবে? মানুষ মানসম্মানের জন্যই দল করে। দল থেকে কয়েক বছর ধরে সম্মান পাইনি। দলের কেউ কোনো কিছুর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করেনি। দল ও দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে মূল্যায়ন পাইনি। মূল্যায়ন না পেলে দল করে কী করব। তাই দল থেকে পদত্যাগ করেছি।’
যে কারণে সরাইল বিএনপিতে ভাঙন
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর সরাইল উপজেলা বিএনপির ১৮৯ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে জেলা বিএনপি। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। এরপর ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় দলছুট আনিছুল ইসলাম ঠাকুরকে আর সদস্যসচিব করা হয় অপর দলছুট নুরুজ্জামান লস্করকে। ওই আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে টানা কয়েক মাস বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন দলের একাংশের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা কয়েকবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।
উভয় পক্ষের মধ্যে উপজেলা সদরে একাধিকবার হামলা-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কয়েক শ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। নেতা-কর্মীরা কয়েক মাস জেলও খেটেছেন। আন্দোলনকারীরা ছিলেন সাত্তারপন্থী।
এর মধ্যে গত বছরের ২৩ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতিতে নুরুজ্জামান লস্করের বাড়িতে দ্বিবার্ষিক সম্মেলন হয়। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সম্মেলনে আনিছুল ইসলাম ঠাকুরকে সভাপতি, নুরুজ্জামান লস্করকে সাধারণ সম্পাদক ও দুলাল মাহমুদ আলীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে তিন সদস্যের উপজেলা কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ও জেলা বিএনপি। এখনো সেই কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি।
২৭ বছর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আনোয়ার হোসেন স্থানীয়ভাবে উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তিনি বর্তমান উপনির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিছুল ইসলাম ঠাকুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁকে (সাত্তার ভূঁইয়া) অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি। নির্বাচন বর্জন করে আসছি। আমরা এই নির্বাচন মানি না। এই মুহূর্তে নির্বাচনবিরোধী কোনো প্রচারণাও করছি না, তাঁকে প্রতিহত করতেও যাচ্ছি না। তবে বিএনপির কোনো ভোটার তাঁকে ভোট দিতে যাবেন না। তাঁর নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেওয়ায় ইতিমধ্যে কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের জন্য আরও তালিকা করা হচ্ছে। নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে—এমন অনেককেই বহিষ্কার করা হবে।’