রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বড়বিল ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিএফের চাল বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় দুজনকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। গ্রাম পুলিশের এক সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজনের বিরুদ্ধে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল বুধবার বড়বিল ইউনিয়ন পরিষদে এ ঘটনা ঘটে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে সেখানে চাল বিতরণ করা হয়।
আহত দুজনের মধ্যে যামিনী বর্মণকে (৬০) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। ওই ঘটনার পরে উপকারভোগীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টা চাল বিতরণ বন্ধ রাখা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে থানা–পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে বিকেলে আবার সেখানে চাল বিতরণ শুরু করা হয়।
গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ভিজিএফ কার্ডধারীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৮২৫। এর মধ্যে বড়বিল ইউনিয়ন পরিষদে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ৩২৩টি কার্ড। বিধিমোতাবেক বিনা মূল্যে প্রত্যেক কার্ডধারীকে দেওয়া হয় ১০ কেজি করে চাল।
উপকারভোগীরা জানান, গতকাল সকাল ৮টায় বড়বিল ইউনিয়ন পরিষদে চাল বিতরণ শুরু করার কথা থাকলেও তা শুরু হয় বেলা ১১টায়। এরপর সেখানে উপস্থিত থাকা চালের ব্যাপারীরা (ফড়িয়া ব্যবসায়ী) পাঁচটি করে ভিজিএফের স্লিপ জমা দিয়ে ৫০ কেজির চালের বস্তা তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিজিএফ কার্ডধারীদের চাল পেতে দেরি হতে থাকে। একপর্যায়ে বেলা তিনটার ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে থাকা এক ব্যবসায়ী ৩০-৩৫টি স্লিপ জমা দিয়ে চালের বস্তা নেওয়া শুরু করেন। এতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিজিএফ কার্ডধারী উপজেলার ঠাকুরদহ গ্রামের যামিনী বর্মণ ও মিলন চন্দ্র রায় (২৬) প্রতিবাদ করেন। এরপরই সেখানে উপস্থিত থাকা গ্রাম পুলিশ সদস্য লেবু মিয়া ও চেয়ারম্যানের লোকজন ওই দুজন ভিজিএফ কার্ডধারীকে লাঠি দিয়ে মারধর করেন।
গ্রাম পুলিশ সদস্য লেবু মিয়া ও চেয়ারম্যানের চার-পাঁচজন লোক আমাকে লাঠি দিয়ে মেরেছেন। আমাকে অন্যায়ভাবে যারা মেরেছে, আমি তাদের বিচার চাই।যামিনী বর্মণ, মারধরে আহত ব্যক্তি
আহত যামিনী বর্মণ সন্ধ্যায় হাসপাতালে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘চাল বিতরণের শুরু থেকেই একেকজন চাল ব্যবসায়ী স্লিপ জমা দিয়ে চালের বস্তা নেওয়া শুরু করেন। বেলা তিনটার দিকে ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে দেখতে পাই, একজন চাল ব্যবসায়ী ৩০-৩৫টি স্লিপ জমা দিয়ে চাল নিচ্ছেন। এর প্রতিবাদ করলে গ্রাম পুলিশ সদস্য লেবু মিয়া ও চেয়ারম্যানের চার-পাঁচজন লোক আমাকে লাঠি দিয়ে মেরেছেন। আমাকে অন্যায়ভাবে যারা মেরেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’
মারধরের শিকার মিলন চন্দ্র রায় অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা তো চাল ছিনতাই করতে যাইনি। চাল তুলতে গিয়ে দেখি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অনিয়ম। এই অনিয়মের প্রতিবাদ করাটা কি অন্যায়? উল্টো আমাকে মারধর করেছে। আমি প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু বিচার চাই।’
ঠাকুরদহ এলাকার ভিজিএফ কার্ডধারী হাসিনা বেগম অভিযোগ করেন, ‘চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কিছু কার্ড গরিব মানুষকে দিয়েছেন। আর বেশির ভাগ কার্ডের স্লিপ তাঁরা চালের ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। কোনো কোনো মেম্বার চালের স্লিপ নিজের পকেটে রেখে সুযোগ বুঝে আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে চাল তুলে নিয়েছেন।’
এদিকে শেষ পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও চাল পাননি ঠাকুরদহ এলাকার শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সকাল থাকি না খায়া লাইনোত দাঁড়েয়া আচনু। চোখের সামনোতে ব্যাপারীরা বস্তায় বস্তায় চাউল তুলে নিয়া গেইচে। তাও মোক চাউল দেয় নাই।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার দিচে হামাক ঈদ করা জন্য চাউল। আর চেয়ারম্যান-মেম্বারেরা হামার গবিরের চাউল বেচে খাওচে।’
‘চাল বিতরণে আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। আমাকে রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে একটি চক্র। আমার কোনো লোকজন কাউকে মারধর করেনি।শহীদ চৌধুরী, বড়বিল ইউপির চেয়ারম্যান
অভিযুক্ত গ্রাম পুলিশ সদস্য লেবু মিয়া বলেন, ‘আমি কাউকে মারধর করিনি। হুড়াহুড়িতে ওই বৃদ্ধ পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন।’
এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান শহীদ চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, ‘চাল বিতরণে আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। আমাকে রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে একটি চক্র। আমার কোনো লোকজন কাউকে মারধর করেনি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না গতকাল বলেন, ‘ওই ইউনিয়নে চাল বিতরণের কিছু অনিয়মের অভিযোগ শুনেছি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভিজিএফ কার্ডধারী কাউকে মারধর করা হলে সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।’