বগুড়ায় করতোয়া নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ ও গতিপথ বাধাগ্রস্ত করে মাটি এবং বালু দিয়ে ভরাট করে নদীর ওপর চলাচলের রাস্তা নির্মাণের অভিযোগে বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘকে (টিএমএসএস) ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের লিখিত অঙ্গীকারের পরও নদীতে মাটি ও বালু ফেলে ভরাট কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় আজ সোমবার বেলা দুইটার দিকে টিএমএসএসকে ওই জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আদালত পরিচালনা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজা পারভীন।
ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার নওদাপাড়া এলাকায় টিএমএসএসের ইকো পার্কের ভেতরে করতোয়া নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ ও স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত করে মাটি এবং বালু দিয়ে ভরাট করে নদীর ওপর দিয়ে চলাচলের রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ পায় উপজেলা প্রশাসন। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার টিএমএসএসের ইকো পার্কে যান ইউএনও ফিরোজা পারভীন। এ সময় মাটি ভরাটের কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকেরা ইউএনওকে জানান, তাঁরা টিএমএসএসের হয়ে নদী মাটি দিয়ে ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের কাজ করছেন। নদী ভরাটের সত্যতা পেয়ে ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে চাইলে টিএমএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম সেখানে উপস্থিত হয়ে ভরাট করা জায়গা টিএমএসএসের নিজস্ব সম্পত্তি বলে দাবি করেন। পরে সিদ্ধান্ত হয়, মাপজোখ করে নদীর সীমানা চূড়ান্ত চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত ভরাটের কাজ বন্ধ থাকবে এবং মাপজোখে নদীর সীমানা প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী যে দণ্ড দেওয়া হবে, টিএমএসএস তা মেনে নেবে বলে নির্বাহী পরিচালক লিখিত অঙ্গীকারও করেন।
ইউএনও ফিরোজা পারভীন বলেন, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার উপজেলা ভূমি কার্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও টিএমএসএসের পক্ষ থেকে নিয়োগ করা সার্ভেয়ার দিয়ে নদীর সীমানা নির্ধারণে যৌথ মাপজোখ বা জরিপ কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নির্বাহী পরিচালকের ওই লিখিত অঙ্গীকার লঙ্ঘন করে করতোয়া নদীর পানিপ্রবাহ ও স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত করে বালু এবং মাটি দিয়ে ভরাট অব্যাহত রেখেছে টিএমএসএস। পরে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৯৯৫–এর ১৫ ধারায় টিএমএসএসকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। টিএমএসএসের পক্ষে এই অর্থদণ্ড করা হয় সংস্থার সহকারী পরিচালক নজিবুল ইসলামকে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও ফিরোজা পারভীন বলেন, আদালতের আদেশ লঙ্ঘন হলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ের পরপরই সেখানে উপস্থিত হন টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম। এ সময় তিনি আদালতকে বলেন, লিখিত অঙ্গীকার অনুযায়ী মাটি ভরাটের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নদী ভরাট করে মানুষ চলাচলের অস্থায়ী এ রাস্তা নির্মাণ টিএমএসএস করছে না। এ রাস্তা নির্মাণ করছেন এলাকাবাসী।
তবে ইউএনও বলেন, নদী ভরাট করে রাস্তা নির্মাণে এলাকাবাসী জড়িত নন। নারী শ্রমিকেরাও ভিডিওতে ভাষ্য দিয়েছেন, তাঁরা টিএমএসএসের হয়ে মাটি ও বালু দিয়ে ভরাটের কাজ করছেন। কাজেই নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে ও স্রোতধারা ব্যাহত করে চলাচলের রাস্তা নির্মাণে টিএমএসএস জড়িত, সেটা ভ্রাম্যমাণ আদালত নিশ্চিত হয়েই ওই রায় দিয়েছেন।
এর আগেও ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসন করতোয়া নদীর দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে। সেখানে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে একাধিক স্থানে করতোয়া নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলার মহিষবাথান মৌজায় করতোয়া নদীর ৪ দশমিক ৯০ একর জমি দখল করে আধা পাকা অবকাঠামো নির্মাণ করার অভিযোগ ওঠে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে নদীর সীমানা দখল করে টিএমএসএস মহিলা মার্কেট সম্প্রসারণ করারও অভিযোগ ওঠে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে দেওয়া করতোয়া দখলকারীর তালিকাতেও ছিল টিএমএসএসের নাম।
এ নিয়ে ২০১৯ সালের ৬ মার্চ প্রথম আলোতে ‘দখল-দূষণে এগিয়ে টিএমএসএস’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।
টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম দাবি করেন, নদীর এই ৪ দশমিক ৯০ একর জমি সংস্থার পক্ষ থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছে। করতোয়া নদী দখলের সঙ্গে টিএমএসএসের সংশ্লিষ্টতা নেই। উল্টো টিএমএসএস ইকো পার্ক এলাকায় করতোয়াকে দৃষ্টিনন্দন করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।