নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা নারীর মুক্তিপ্রত্যাশী উপন্যাস ‘সুলতানা’স ড্রিম’ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘বিশ্বস্মৃতি’ বা ‘ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ উপলক্ষে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে আজ শনিবার একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ইউনেসকো ঢাকা দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এই অর্জন উদ্যাপন করা হয়। মনি-শংকর স্মৃতি পাঠাগার এই অনুষ্ঠানে সহায়তা করে।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে ‘সুলতানার স্বপ্ন এবং আমার ভাবনা’ শীর্ষক পাঠ প্রতিক্রিয়া কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর আগে আমন্ত্রিত অতিথিরা বেগম রোকেয়ার ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। অনুষ্ঠানের শুরুতে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন মাহনাজ মৈত্রী।
‘সুলতানার স্বপ্নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি উদ্যাপন কমিটি’র আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর। আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনের সংসদ সদস্য জাকির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক একুশে পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক মিনার মনসুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন উদ্যাপন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহবুব রব্বান জুয়েল।
সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘বেগম রোকেয়া যা করতে চেয়েছিলেন, তাঁর সাফল্যের একটি বড় অংশ তো আমাদের সামনেই বসে আছেন, আমাদের ছাত্রীরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীশিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন এবং সেখানে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আজকে আমাদের প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে, সেনাবাহিনীতে, বিচার বিভাগে—এমন কোনো স্থান নেই যেখানে নারীরা নেই। আমি অন্তত আমার নির্বাচনী এলাকায় কয়েক বছর ধরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যাঁদের পাচ্ছি, তাঁরা প্রত্যেকেই নারী। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা তাঁদের কাজ পরিচালনা করছেন।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যাঁর জন্ম হয়েছে এই মাটিতে, সেখানেই আমরা উদ্যাপন করছি এমন একটি অনুষ্ঠান। এটি একটি আনন্দের সংবাদ। রোকেয়ার “সুলতানার স্বপ্ন” রংপুরের গর্ব, পায়রাবন্দের গর্ব, মিঠাপুকুরের গর্ব। বাংলাদেশের গর্ব। ইউনেসকোর যে স্বীকৃতি, বাংলাদেশের এক নারীর ১৯০৫ সালে লেখা একটি ইংরেজি রচনা। সেটার মধ্যে যে অসাধারণ শক্তি নিহিত আছে, সেটার স্বীকৃতি এটি। আজ এই ঘটনার প্রথম উদ্যাপন হচ্ছে রোকেয়ার জন্মভূমিতে। এই উদ্যাপনের বার্তা আমরা চারপাশে ছড়িয়ে দিতে চাই। “সুলতানার স্বপ্ন”–এর যে বার্তা, সেটা নতুন প্রজন্মের মধ্যে, সমাজের মধ্যে যেন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
অনুষ্ঠান মঞ্চে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য সরিফা সালোয়া, জেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিজুল ইসলাম, আইনজীবী কমল মজুমদার, আমজাদ সরকার, শাশ্বত ভট্টাচার্য, রাজু আহমেদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ইউনেসকোর লোগোসংবলিত সনদ ও বই প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে পাঠ প্রতিক্রিয়ায় তিনটি বিভাগে ১১ শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হয়।
গত ৮ থেকে ১০ মে মঙ্গোলিয়ার উলান বাটোরে অনুষ্ঠিত হয় ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কমিটি ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক’ বা মৌক্যাপের দশম সাধারণ সভা। ওই সভায় ইউনেসকোর ‘বিশ্বস্মৃতি’ বা ‘ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় ‘সুলতানা’স ড্রিম’-এর স্থান পাওয়ার ঘোষণাটি দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ স্বীকৃতি গ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।
ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড মেমোরির এবারের তালিকায় আরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৯টি দেশের আরও ১৯টি স্মরণীয় প্রামাণ্য দলিল। সেগুলোর মধ্যে আছে ভারতের তুলসীদাস রচিত ‘রামচরিত মানস’-এর পাণ্ডুলিপি, চীনের ঐতিহ্যবাহী চেংরু টি হাউস মহাফেজখানা অথবা ইন্দোনেশিয়ার ইমাম বনজলের পাণ্ডুলিপি। স্বীকৃতির তালিকায় দ্বিতীয় নামটি বাংলাদেশের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মৌক্যাপের কাছে ‘সুলতানা’স ড্রিম’-এর নামের আবেদন জানিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।