কয়েক শ একর জমির আউশ ধান পেকে গেছে এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে। স্থানীয় যুবদলের এক নেতার সিন্ডিকেটের দুটি কম্বাইন হারভেস্টারে (ফসল কাটা ও মাড়াই করার যন্ত্র) এসব কৃষকের ধান কেটে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই দুটি যন্ত্রের একটি পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় হওয়ায় এক দিন কাটলে তা দুদিন থাকে অকেজো। আবার এই দুটি হারভেস্টার অন্য গ্রামে গিয়েও ধান কাটছে। এই পরিস্থিতিতে অন্য লোকের হারভেস্টার যন্ত্র ভাড়া করে এনে ধান কাটার উদ্যোগ নিলেও তাতে বাধা দিচ্ছেন ওই যুবদল নেতা ও তাঁর সহযোগী বিএনপির কর্মীরা।
এমনকি অন্য হারভেস্টার আনার চেষ্টা করায় কয়েকজন কৃষককে এই সিন্ডিকেটর লোকজন মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আড়াই শতাধিক কৃষক তাঁদের পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তাঁদের প্রায় ৫০০ একর জমির পাকা ধান কাটতে না পারায় ঝরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বরগুনার আমতলী উপজেলার পশ্চিম সোনাখালী গ্রামের ঘটনা এটি। আঠারগাছিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ফিরোজ মৃধা ও তাঁর সহযোগীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন ওই এলাকার ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
পশ্চিম সোনাখালী গ্রামটি পটুয়াখালীর শাখারিয়া এলাকা লাগোয়া। আজ শনিবার সকালে আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের এই গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে কয়েক শ একরজুড়ে পাকা আউশ ধান খেতে পড়ে আছে। এসব ধান বেশ কয়েক দিন আগে পেকে যাওয়ায় ঝরে যাচ্ছে। বৃষ্টি-কাদাজলে পচে যাচ্ছে।
এই এলাকার কৃষকেরা জানান, এবার গ্রামের অন্তত আড়াই শ কৃষক ৫০০ একর জমিতে আউশ আবাদ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছে। অন্তত আট দিন আগে এই ধান পেকে কাটার উপযোগী হয়ে গেছে। কিন্তু হারভেস্টার যন্ত্রের অভাবে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছেন না। এতে পাকা ধান ঝরে পড়ছে। বৃষ্টি-কাদায় পচে যাচ্ছে। ফলে কৃষকেরা মারাত্মক লোকসানের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
ধান কাটতে না পারায় নিজেদের দুর্দশার বর্ণনা করে গ্রামের কৃষক মোকলেসুর রহমান মৃধা ও জহির মৃধা বলেন, জমির পাকা ধান জমিতেই পচে যাচ্ছে। অন্য এলাকা থেকে হারভেস্টার যন্ত্র এনে ধান কাটার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যুবদল নেতা ফিরোজ মৃধা ও তাঁর সহযোগী মাসুম মৃধা, শাহ নেওয়াজ ও আলাউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি কর্মী এতে বাধা দেওয়ায় ধান কাটাতে পারেননি। এই দুই কৃষক আক্ষেপ করে বলেন, একে তো ধান মাঠে নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে আমন ধান রোপণের জন্য জমি চাষাবাদ করবেন, সেটাও পারছেন না। আমন রোপণের মৌসুম শেষ হওয়ার পথে। জানেন না এখন কী করবেন।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা জানান, এই এলাকার কৃষকদের ধান কাটার জন্য আঠারগাছিয়া ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি ফিরোজ মৃধা তাঁর সহযোগীদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। তাঁরা কৃষকদের তাঁদের মাধ্যমেই ধান কাটার জন্য অঘোষিতভাবে চাপ দেন। একই সঙ্গে অন্য এলাকা থেকে হারভেস্টার যন্ত্র ঢুকতে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন। বাধ্য হয়ে কৃষকেরা ওই নেতার যন্ত্র দিয়েই ধান কাটাতে রাজি হন। প্রতি একর তিন হাজার টাকা করে ধান কাটার চুক্তি হয়। এরপর ফিরোজ মৃধা ও তাঁর লোকজন দুটি হারভেস্টার যন্ত্র ভাড়ায় আনেন। এর একটি যন্ত্র জরাজীর্ণ হওয়ায় প্রায়ই অকেজো হয়ে যায়। ফলে এই বিপুল আয়তনের জমির ধান সময়মতো কাটতে পারছিল না। আবার নিজের এলাকার কৃষকদের জিম্মি করে রেখে আগে অন্য এলাকার ধান কেটে দিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। ফলে পশ্চিম সোনাখালী গ্রামের কৃষকেরা তাঁদের মাঠের পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে কয়েকজন কৃষক অন্য এলাকা থেকে হারভেস্টার যন্ত্র ভাড়া করে ধান কাটার উদ্যোগ নিলেও তাতে বাধা দেয় এই চক্র। এমনকি ওই হারভেস্টার যন্ত্রের মালিকদের তাঁরা নানাভাবে হুমকি দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন। ওই এলাকার কৃষক নান্না পেয়াদা বলেন, ‘খেতে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমি অন্য লোকের হারভেস্টার যন্ত্র এনে ধান কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে ফিরোজ মৃধা ও তাঁর সহযোগীরা ধান কাটতে নিষেধ করেছে। আমি তাঁদের নিষেধ না শুনে ধান কেটেছি। এতে আমাকে তাঁরা মারধর করে ৬০ হাজার টাকা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে।’
সবুজ দরজি নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘ধান কাটতে অন্য লোকের হারভেস্টার যন্ত্র এনেছিলাম। কিন্তু ফিরোজ মৃধা, মাসুম মৃধা, আলাউদ্দিন ও শাহ নেওয়াজ ধান কাটতে দেয়নি। ফলে খেতের ধান খেতেই পড়ে নষ্ট হচ্ছে। আমরা কি এর কোনো প্রতিকার পাব না?’
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে যুবদল নেতা ফিরোজ মৃধা প্রথমে তাঁর কোনো হারভেস্টার যন্ত্র থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিবেশী এক ছোট ভাই (শাহ নেওয়াজ) দুটি যন্ত্র ভাড়ায় এনে ধান কাটছেন। আমি এতে সহযোগিতা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি কৃষকদের ধান কাটতে বাধা দিইনি। আমার দল জনগণের পক্ষে কাজ করে, আমি ধান কাটতে কেন বাধা দেব? বরং আমি ওদের একটি যন্ত্র ভালো কাজ করে না বলে নিজে ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়ায় দিনাজপুর থেকে আরেকটি যন্ত্র আনিয়ে দিয়েছি। ওরা তো শনিবার সকাল থেকে ধান কাটছে। দুদিনের মধ্যে সব ধান কাটা হয়ে যাবে।’
তবে পশ্চিম সোনাখালী গ্রামে আজ বেলা একটা পর্যন্ত সেখানে কোনো হারভেস্টার যন্ত্র চোখ পড়েনি। মাঠে পাকা ধান পড়ে থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয় ভুক্তভোগী কৃষকেরা নিরুপায় হয়ে উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি কৃষকদের মাধ্যমে আমি জেনেছি। দ্রুত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ধান কাটার উদ্যোগ নেব।’ ইউএনও আরও বলেন, ‘ফিরোজ মৃধাসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি, তাঁদের ডাকা হয়েছে।’