কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পশ্চিম পাশে নিরিবিলি পরিবেশের প্যাঁচারদ্বীপ সমুদ্রসৈকত। যাতায়াত–সুবিধা না থাকায় এখানে মানুষের পদচারণ খুব একটা নেই। সৈকতজুড়ে দেখা যায় লাখোকোটি লাল কাঁকড়ার রাজত্ব। ভেজা বালুর চরজুড়ে থরে থরে সাজানো দৃষ্টিনন্দন আলপনা। মনে হবে, কোনো দক্ষ শিল্পীর নৈপুণ্যে বালু দিয়ে তৈরি আলপনা। একটি আলপনার সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। আলপনাগুলো তৈরির কারিগর লাল কাঁকড়া। আলপনার ভেতরে-বাইরে গর্ত খুঁড়ে তৈরি হয় বাসা। আর সেই বাসাতেই জীবনযাপন লাল কাঁকড়ার।
১৬ নভেম্বর সরেজমিন দেখা গেছে, প্যাঁচারদ্বীপের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার রাজত্ব। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ভেজা বালুর ওপর লালের আস্তর। ইচ্ছা করবে দৌড়ে কয়েকটা কাঁকড়া ধরতে, তা কিন্তু মোটেও সম্ভব নয়। কাছে যেতে চাইলে মুহূর্তে কাঁকড়াগুলো গর্তে ঢুকে পড়ে। তবে প্যাঁচারদ্বীপের কথা বাদ দিলে কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সৈকতের বেশির ভাগ অংশেই এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরীর সঙ্গে সৈকত এলাকায় দেখা হয় গত শনিবার। লাল কাঁকড়া নিয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সমুদ্রসৈকতের সব জায়গায় ৩০ বছর আগেও লাল কাঁকড়ার রাজত্ব দেখা যেত। পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, বালুচরে বিচ বাইক, মোটরসাইকেল, জিপ গাড়ি ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের (টমটম) বেপরোয়া চলাচলের কারণে লাল কাঁকড়া বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
সৈকতে দাঁড়িয়ে ১০-১৫ মিনিট লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখলে মনে হবে, এই প্রাণীর জীবন বেশ সুশৃঙ্খল। দল বেঁধে ছুটে চলে প্রাণীগুলো। সৈকতের জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ লাল কাঁকড়া এখন বিপন্ন। মানুষই তাদের বড় শত্রু বলে মনে করেন পরিবেশকর্মীরা। পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, লাল কাঁকড়ার জীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর। পুরো শরীর লাল, চোখ দুটি শুধু সাদা। একটা সময় ১২০ কিলোমিটার সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়া দেখা যেত। মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে লাল কাঁকড়ার প্রায় বিলুপ্তি ঘটছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় সৈকতে যখন পর্যটকের সমাগম বন্ধ ছিল, তখন লাল কাঁকড়ার দ্রুত বিস্তার ঘটে। পুরো সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখা যায়। করোনা মহামারির নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহারের পর লোকসমাগম বাড়তে থাকলে লাল কাঁকড়াও উধাও হয়ে যায়।
হিমছড়ি এলাকার জেলে ছৈয়দ হোসেন (৪৬) সৈকতে বহু বছর ধরে মাছ ও চিংড়ির পোনা ধরেন। তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগেও এই সৈকতে হাজারো লাল কাঁকড়া দেখা যেত। এখন মানুষের সমাগম বেড়েছে বলে লাল কাঁকড়া উধাও হয়েছে।
জেলেরা জানান, সৈকত ভ্রমণে আসা লোকজন তাড়া করে কাঁকড়া ধরতে চান। শিশুরা গর্তের ভেতর থেকে কাঁকড়া ধরে রশি দিয়ে বেঁধে খেলা করে। মানুষের পায়ের তলায় পড়ে ভেঙে যায় লাল কাঁকড়ার শত শত বাসা। মারা যায় কাঁকড়ার অসংখ্য বাচ্চা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা মরা মাছ, শামুক-ঝিনুক, মাছের পোনা ও ময়লা-আবর্জনা কাঁকড়ার প্রিয় খাবার। ১৬ প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাল কাঁকড়া। এ প্রজাতির কাঁকড়া সৈকতের ময়লা-আবর্জনা সাফ করে সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক এইচ এম নজরুল বলেন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণে ২০০৮ সালে সৈকতে বিচ বাইকের চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে পুনরায় ৩০টি বিচ বাইক চালানো শুরু হয়। এখন বিচ বাইকের সংখ্যা ১৪০টির বেশি। বিচ বাইকের চাকায় পিষ্ট হয়ে বেশির ভাগ লাল কাঁকড়ার মৃত্যু হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, দরিয়ানগর থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সৈকতের ১০-১৫টি পয়েন্টে লাল কাঁকড়ার বিচরণ ছিল, লোকসমাগম বাড়তে থাকায় কাঁকড়া হারিয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিচ বাইকসহ যানবাহনের চলাচল বন্ধ করা উচিত।