বুলবুল হত্যায় স্বীকারোক্তি

শার্টের কলার চেপে ধরে বুকে ছুরি বসান কামরুল

নিহত শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদ
ছবি : সংগৃহীত

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী মো. বুলবুল আহমেদকে (২২) হত্যার অভিযোগে যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তাঁরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, সেটিও উঠে এসেছে জবানবন্দিতে।

২৫ জুলাই শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনার পরদিন ২৬ জুলাই মো. আবুল হোসেন (১৯) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন গ্রেপ্তার করা হয় মো. হাসান (১৯) ও কামরুল আহমদ (২৬) নামের আরও দুজনকে। তাঁরা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী টিলারগাঁও এলাকার বাসিন্দা। জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, এ তিনজন পেশায় রাজমিস্ত্রি হলেও মূলত ছিনতাইকারী।

গ্রেপ্তারের পর তাঁরা তিনজনই সিলেটের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক মো. সুমন ভূঁইয়ার কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দির নথিগুলো প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের কাছে আছে। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে গিয়ে কীভাবে বুলবুলকে তাঁরা হত্যা করেন, তাঁর বর্ণনা দেওয়া আছে সেখানে।

তিনজনের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় মো. হাসান মুঠোফোনে কামরুল আহমদকে কল দেন। হাসান মুঠোফোনে কামরুলকে জানান, গাজী-কালুর টিলায় একটি ছেলে (বুলবুল) ও একটি মেয়ে বসে কথা বলছেন। মো. আবুল হোসেন তাঁদের নজরদারিতে রেখেছেন। এই ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে ছিনতাই করা যাবে বলে কামরুলকে জানান তিনি। এর ১০ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে টিলায় এসে পৌঁছান কামরুল। এরপর হাসান ও আবুলকে ওই শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠান তিনি।

কামরুল তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈদ্যুতিক বাতির আবছা আলোয় একপর্যায়ে তিনি দেখেন, হাসান ও আবুল ছেলেটির সঙ্গে কস্তাকস্তি (মারামারি) করছেন। তা দেখে তিনিও এগিয়ে যান। পরে দেখেন, আবুল ও হাসান ছেলেটিকে টেনে একটু ভেতরের দিকে নিয়ে আসেন। এ সময় মেয়েটি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ভয়ে চিৎকারও করতে পারছিলেন না।

ছেলেটা যখন জোর করছিল, তখন আমি তাঁর পরিহিত শার্টের সামনের দিকের কলার ধরে আমার পকেটে থাকা ছুরি বের করে তাঁর বুকে একটি আঘাত করি। ছেলেটি নুইয়ে পড়লে পিঠ বরাবর একটি আঘাত করি, ডান হাতের বাহুতে আরেকটি আঘাত করি
জবানবন্দিতে গ্রেপ্তার কামরুল আহমদ

কামরুল জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমরা যখন ছেলেটির কাছে মোবাইল-মানিব্যাগ চাই, ছেলেটি তখন ভার্সিটির ছাত্র দাবি করে মোবাইল-মানিব্যাগ দিতে অস্বীকার করল এবং চিৎকার করে আরও ছাত্রদের ঘটনাস্থলে এনে আমাদের শায়েস্তা করার ভয় দেখায়। ছেলেটা যখন জোর করছিল, তখন আমি তাঁর পরিহিত শার্টের সামনের দিকের কলার ধরে আমার পকেটে থাকা ছুরি বের করে তাঁর বুকে একটি আঘাত করি। ছেলেটি নুইয়ে পড়লে পিঠ বরাবর একটি আঘাত করি, ডান হাতের বাহুতে আরেকটি আঘাত করি।’
তিনজনের জবানবন্দি থেকে আরও জানা যায়, বুলবুলকে আঘাতের পর তিনজনই ভয় পেয়ে যান এবং দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর হাসান ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে আসা বুলবুলের মুঠোফোন কামরুলকে দেন। কামরুল সেই মুঠোফোন ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত ছুরি তাঁর বাসায় বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো ছাদের ওপর রাখেন। পরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর কামরুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ ওই জায়গা থেকে মুঠোফোন ও ছুরি জব্দ করে।

জবানবন্দিতে মো. আবুল হোসেন জানান, ঘটনার দিন বিকেল চারটার দিকে হাসান ও তিনি গাঁজা সেবন করার জন্য গাজী-কালুর মাজারের টিলায় গিয়েছিলেন। মাজারের পূর্ব দিকে বসে সিগারেটের ভেতর গাঁজা ঢুকাচ্ছিলেন তাঁরা। এ সময় তাঁরা দেখেন, মাজারের পশ্চিম দিকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বসে কথা বলছেন। গাঁজা সেবন শেষ হলে হাসান মুঠোফোনে কামরুলকে কল করে বলেন, ‘কামরুল ভাই, টিলা একেবারে নিরালা, ছাত্রছাত্রী আছে, ধান্ধা করা যাইব।’ এরপরই কামরুল ঘটনাস্থলে আসেন।

মো. আবুল হোসেন জবানবন্দিতে বলেন, ‘ছেলেটা মোবাইল বা মালামাল দিতে রাজি হয় না। মেয়েটা রাজি হয়ে যায়। ছেলেটা মোবাইল দিয়ে দিতে না চাইলে হাসান এবং কামরুলের ধস্তাধস্তি হয় ছেলেটার সঙ্গে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছেলেটার পকেট থেকে তাঁর মোবাইল পড়ে যায়, মেয়েটা আনুমানিক ৮-১০ হাত দূরে দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদেরকে ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে এবং মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে বলছিল। কিন্তু ছেলেটা মোবাইল দেবে না জানিয়ে হাসান ও কামরুলের সঙ্গে কস্তাকস্তি করছিল।’
জবানবন্দিতে আবুল আরও বলেন, ‘হাসান মাটিতে পড়ে যাওয়া ছেলেটার মোবাইলটা নিচ্ছিল, এমন সময় কামরুল তাঁর পকেট থেকে ছুরি বের করে ছেলেটার শার্টের কলারে ধরে তাঁর বুকে, পিঠে, বাহুতে তিনটি আঘাত করে। ছেলেটা মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায়, হাসান ছেলেটার মোবাইলটি কামরুলের কাছে দেয়, মেয়েটা চিৎকার করছিল। তখন আমরা ভয়ে গাজী-কালুর মাজারের পূর্ব দিকে অডিটরিয়ামের পেছন দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই।’

মো. হাসান তাঁর জবানবন্দিতে জানান, কামরুল ঘটনাস্থলে আসার সময় লাকড়ি কাটার লোহার হাতলওয়ালা একটি দা নিয়ে আসেন। সেই দা-টি কামরুল আবুলের কাছে দেন। পরে আবুল ওই দা ছেলেটার গলায় ধরে তাঁকে একটু ভেতরের দিকে নিয়ে যান।
গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের জবানবন্দি ও মামলার সার্বিক তদন্ত বিষয়ে সিলেট মহানগরের উপপুলিশ কমিশনার মো. আজবাহার আলী শেখ প্রথম আলোকে বলেন, এ জবানবন্দির মাধ্যমে বুলবুল হত্যায় কার কী ভূমিকা, সেটি স্পষ্ট হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন আছে। পুলিশ পুরো ঘটনার পরম্পরা পর্যবেক্ষণ করে তদন্ত এগোচ্ছে।

ছুরিকাঘাতে নিহত শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদের মা ও বোনেরা এসে বুলবুলের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও জিনিসপত্র নিয়ে যান। রোববার দুপুরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবারের সদস্যদের হাতে এসব তুলে দেওয়া হয়

বুলবুল হত্যার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে গাজী-কালু টিলা লাগোয়া ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকায় এক ছাত্রীসহ ঘুরতে গিয়েছিলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. বুলবুল আহমেদ। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি ছুরিকাহত হন। পরে তাঁকে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রাতেই সিলেট মহানগরের জালালাবাদ থানায় হত্যা মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন।

মামলার পরপরই পুলিশ গত ২৫ ও ২৬ জুলাই তিন ছিনতাইকারীকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে। তাঁদের মধ্যে আবুল হোসেনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ২৭ জুলাই কামরুল ও হাসানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নিহত বুলবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের ২১৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন। তাঁর বাড়ি নরসিংদী সদর উপজেলার নন্দীপাড়া গ্রামে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা দোষীদের বিচার ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করেন।

সর্বশেষ গতকাল রোববার বুলবুলের মা, ভাই, দুই বোনসহ পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুলবুলের ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে যান। এ সময় তাঁরা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, কেবল ছিনতাইয়ের জন্য বুলবুল এমন নৃশংসভাবে খুন হতে পারেন না। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেটা অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে বের করা হোক।