শহীদ দিবস, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস এলেই অন্য রকমের তাড়া অনুভব করেন তিনি। তাঁকে বলে দিতে হয় না, ঝেড়েমুছে নিজেই ঘরের কোণে পড়ে থাকা তুলিগুলো প্রস্তুত করেন। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে স্বেচ্ছায় মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠসংলগ্ন শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভে আলপনা আঁকছেন সালেহ এলাহী ওরফে কুটি। তিনি একজন সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মী।
আলপনা আঁকা সালেহ এলাহীর কাছে শখের কাজ। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই তিনি মৌলভীবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার কাজটি করে থাকেন। ১২ ডিসেম্বর থেকে শহীদ মিনারে একটু একটু করে রঙে ও রেখায় আলপনা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কখনো দুপুরে, কখনো বিকেলে এ কাজ করেছেন। তুলির টানে রঙিন ও নতুন সাজে ফুটে উঠছে শহীদ মিনারটি। ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে আলপনায় তুলির শেষ আঁচড় দিয়েছেন। মৌলভীবাজার পৌরসভার কর্মীরা আগেই ধুয়েমুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন শহীদ মিনারটি।
সালেহ এলাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটা সময় শহীদ দিবস, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনারে ইচ্ছেমতো আলপনা আঁকতেন। তবে সেটা নিয়মিত ছিল না। কোনো দিবসে আঁকা হতো, অনেক সময় আঁকা হতো না। মৌলভীবাজারে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানে তাঁকে শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই দায়িত্ব পেয়ে তিনি উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হন। সেই থেকে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভে স্বেচ্ছাশ্রমে আলপনা এঁকে চলেছেন।
বিশেষ দিবস এলে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কখনো নিজে থেকেই যোগাযোগ করেন সালেহ এলাহী, আবার কখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর খোঁজ করা হয়। তাঁর কোনো চাওয়া-পাওয়া, দাবি-দাওয়ার বিষয় নেই। আলপনা আঁকার কাজটি তিনি আনন্দের সঙ্গেই করে থাকেন। দিবসগুলোর জন্য যেন তাঁর নীরব এক অপেক্ষাই থাকে। তুলিগুলো তাঁর নিজেরই। তবে কখনো জেলা প্রশাসন, কখনো জেলা পরিষদ, আবার কখনো মৌলভীবাজার পৌরসভা আলপনা আঁকার বাহারি রং দিয়ে থাকে। এবার জেলা প্রশাসন থেকে তাঁকে রং সরবরাহ করা হয়েছে। বিজয় দিবস সামনে রেখে শহীদ মিনার আলপনায় রাঙিয়েছেন তিনি।
আলপনা আঁকার সময় নতুন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, যা আমাকে পীড়া দেয়, বিস্মিত করে।সালেহ এলাহী, আলপনাশিল্পী
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সালেহ এলাহী শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার কাজটি করে যাচ্ছেন। আলপনা আঁকার জন্য তিনি কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে তিনি আলপনা আঁকেন। জাতীয় দিবসগুলো এলেই তিনি আলপনায় শহীদ মিনার সুন্দর করে সাজিয়ে তোলেন।
আলপনা আঁকায় সালেহ এলাহীর কোনো প্রশিক্ষণ নেই, তবে ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। কাগজ-কলম পেলেই আঁকাআঁকি শুরু করে দিতেন। রং তাঁকে খুব টানত। একপর্যায়ে বিয়েবাড়ি বা কোনো অনুষ্ঠানে শখের বশে রংতুলিতে ছবি এঁকে দিয়েছেন। এতে ছবির শিল্পী হিসেবে তাঁর একটা পরিচিতি তৈরি হয়ে যায়। পরিচিতমহলে বিয়ের অনুষ্ঠান হলেই আলপনা আঁকার জন্য তাঁর ডাক পড়ত। আনন্দের সঙ্গে ছুটে গিয়ে আলপনা আঁকার কাজ করে দিতেন তিনি। একসময় প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন আন্দোলনে ও সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনে দেয়ালে দেয়ালে রংতুলিতে স্লোগান লিখেছেন। দেখতে দেখতে এসব আলপনা আঁকায় তাঁর অভিজ্ঞতা আড়াই দশক পেরিয়ে গেছে।
আলপনাশিল্পী সালেহ এলাহী বলেন, ‘আগে পুরোনো শহীদ মিনারে আলপনা আঁকতাম। বিচ্ছিন্নভাবে আঁকা হতো। নানা কারণে দু-এক বছর বাদ যেত। তবে বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তি থেকে নিয়মিত আলপনা আঁকছি। এখন নতুন শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধে আলপনা আঁকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আলপনা আঁকার সময় নতুন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, যা আমাকে পীড়া দেয়, বিস্মিত করে। অনেক কলেজশিক্ষার্থী আসেন। তাঁরা প্রশ্ন করেন, কেন এই ছবি আঁকছি? দিবসগুলোর নাম বললে অনেকে জানতে চান, এদিন কী হয়েছিল? এবার এক ছাত্রী বলেছেন, বিজয় দিবস কবে? এত সংগ্রাম, রক্তপাত ও জীবন দিয়ে পাওয়া একটি দেশ, সেই দেশের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে এখনো অস্পষ্ট।’