মানুষের সেবা করার প্রত্যয়

অভাবের কারণে নুসরাত জাহানের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরিতে পাঠাতে চেয়েছিলেন বাবা; কিন্তু নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। এখন তার স্বপ্ন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করা।

বরিশালের আগৈলঝাড়ার নুসরাত জাহানের মতোই নানা প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে গাইবান্ধার সুবর্ণা রাণী, নাটোরের সুচন্দ মালাকার ও রংপুরের প্রিয়াংকা। তবে তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার খরচ জোগাড় করা নিয়ে।

কবুতর পালন করে সুবর্ণার পড়ালেখা

কবুতরের কিচিরমিচির শব্দে ভোরে ঘুম ভাঙে সুবর্ণা রানীর। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে সে নিজে খেতে না পেলেও খাবার দিতে হয় কবুতরগুলোকে। কারণ, কবুতর লালনপালন করেই জোগাড় হতো পড়াশোনার খরচ। এমন অভাব-অনটনের মধ্যও এবারের এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের তরফবাজিত গ্রামের সুবর্ণা রানী। তার বাবা বিধান চন্দ্র সরকার ঝালাই কারখানায় কাজ করেন। মা দীপালি রানী সরকার গৃহিণী।

তরফবাজিত গ্রামে বসতভিটায় আধা পাকা টিনশেড ঘর। দীপালি রানী বলেন, কত দিন থেকে ছেলেদের বড় মাছ কিংবা মাংস খাওয়াতে পারেন না, তার মনে নেই। সাহায্য করবেন, এমন আত্মীয়স্বজনও নেই। লোকলজ্জায় লাইনেও দাঁড়াতে পারেন না।

সুবর্ণা রানী বলে, কোনো দিন পানি খেয়ে, কোনো দিন বান্ধবীদের আনা টিফিন জুটেছে। বিকেলে বাড়ি ফিরেও পেটভরে খাবার জোটেনি। সে এখন লেখাপড়া করে চিকিৎসক হতে চায়। সংসারের হাল ধরতে চায়।

অভাবেও পড়াশোনা বন্ধ করেনি নুসরাত

অভাবের তাড়নায় মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরিতে পাঠাতে চেয়েছিলেন পত্রিকার হকার সগির সিকদার; কিন্তু মেয়ে নুসরাত জাহান রাজি হয়নি। নিজের চেষ্টা আর পাড়া-প্রতিবেশীর সহায়তায় লেখাপড়া চালিয়ে গেছে।

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের ফুলশ্রী গ্রামের নুসরাত এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। সগির সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তয় মুই ফলাফলে খুশি হইলেও দুশ্চিন্তায় আছি, কলেজে কী দিয়া পড়ামু?’ তিনি বলেন, পত্রিকার হকারি করে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভালোই ছিলেন। কিন্তু মহামারি করোনার সময়ে হঠাৎ অসুস্থতায় কাজ করতে না পেরে আয়ের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় পত্রিকা বিক্রিও কমে যাওয়ায় তিনি মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন।

নুসরাত জাহান বলে, ‘অনেক দিন না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। আজ সব কষ্ট ভুলে গেছি।’ পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা শেষ হয়নি নুসরাতের। চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্নের কথা জানিয়ে সে বলে, ‘কলেজে কী করে ভর্তি হব। আর কী করেই-বা খরচ জুগিয়ে পড়াশোনা করব।’

কলেজে পড়ার খরচের চিন্তায় প্রিয়াংকা

স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরির কাজ করেছে প্রিয়াংকা আক্তার। সেখান থেকে যা আয় হতো, তা দিয়ে লেখাপড়া খরচ চালিয়ে এবারে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। প্রিয়াংকার স্বপ্ন, লেখাপড়া করে চিকিৎসক হবে। কিন্তু অভাবের সংসারে সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কলেজে ভর্তি ও পড়ার খরচ।

প্রিয়াংকাদের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের ওকড়াবাড়ি গ্রামে। বাবা আজিজার রহমান ভ্যানচালক, মা সালমা বেগম গৃহিণী। আয়ের একমাত্র সম্বল প্রিয়াংকার বাবার পুরোনো একটি রিকশাভ্যান। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন যে আয় করেন, তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসারে দুবেলা খাওয়াই কষ্টকর উল্লেখ করে আজিজার রহমান বলেন, ‘মেয়েটা অনেক কষ্ট করি লেখাপড়া করছে। ওয় ডাক্তার হবার চায়। কলেজোত ভর্তি হইবে। কিন্তু মোর ভাঙা ভ্যানোত দিন কামাই ৩০০ টাকা। এই টাকায় পেটের ভাত জোগাড় করির পাও না। ওক কলেজোত পড়াই কেমন করি কন?’

প্রিয়াংকা আক্তার বলে, ‘বাবার দিকে তাকালেই কষ্ট হয়। একজন মানুষ ভাঙা ভ্যান দিয়ে যা কামাই করে, তা দিয়ে আমাদের ছয়জনের খাবার হয়।’

ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, প্রিয়াংকা অত্যন্ত মেধাবী। সে যদি কারও সহযোগিতা পায়, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

লেখাপড়া চালানোর সামর্থ্য নেই সুচন্দের

নাটোরের গুরুদাসপুর সরকারি পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে সুচন্দ মালাকার। গুরুদাসপুর পৌরসভার উত্তর নাড়িবাড়ি মহল্লার সুচনা রানী ও উত্তম মালাকার দম্পতির ছেলে সুচন্দ মালাকার। তারা দুই ভাই। ছোট ভাই সুজয় কুমার মালাকার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

বাবা উত্তম মালাকার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, মা সুচনা মালাকার একটি কেজি স্কুলে ছোট পদে চাকরি করেন। সুচনা মালাকার বলেন, তাঁদের জমিজমা নেই। সুচন্দের মামার ৫ শতাংশ জায়গার ওপর টিনের ছাপরা তুলে সেখানে বসবাস করছেন। ছেলেকে ভালো কলেজে ভর্তি করিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার মতো সামর্থ৵ নেই।

ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পরিবারের অভাব ঘোচানোর স্বপ্ন সুচন্দের। সে বলে, স্বপ্নপূরণে ভালো একটি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করতে চায়। রাজশাহী কলেজ প্রথম পছন্দ তাঁর।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন জহুরুল ইসলাম, গৌরনদী, বরিশাল; শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা, রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর আনিসুর রহমান, গুরুদাসপুর, নাটোর]