বাবা মারা যাওয়ার ১১ বছর পর ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের কান্ডারি হলেন মেয়ে। নতুন অভিভাবক পেয়ে চাঙা স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এর আগে টানা দুই মেয়াদে নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে নির্বাচিত করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তাই এবার নিজেদের প্রার্থী পাওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীর বেশির ভাগ খাদিজাতুলের জন্য মাঠে নামেন। পরাজিত হন নজিবুলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব।
ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হোসাইন মুহাম্মদ আবু তৈয়বের বলয়ে এই বিভক্ত ছিল ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ। তৈয়বের অনুসারীরা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য নজিবুল বশরের সঙ্গে। আর আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীই ছিলেন অনেকটা দোদুল্যমান।
এবারের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার পেয়েছেন ১ লাখ ৬৮৫ ভোট। আর আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব (তরমুজ) ৩৬ হাজার ৫৬৬ ভোট পেয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভান্ডারী নির্বাচনের মাঠে ছিলেন।
শুরুতে নজিবুলকে জোটের শরিক হিসেবে এই আসনটি ছেড়ে দেওয়ার আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। নির্বাচনের তিন দিন আগে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সরে দাঁড়ান। এরপর সুপ্রিম পার্টির সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদকে সমর্থন দিয়ে নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুল নির্বাচনের ১০ দিন আগে সরে যেতে বলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চাপে তিনি সরে যাননি। পরে কেন্দ্র থেকে বলা হয়, ভোটে মাঠে থাকবেন দুজনই। শেষ পর্যন্ত গত রোববার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এক লাখের বেশি ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খাদিজাতুল আনোয়ার। চট্টগ্রামের ১৬ আসনে জয়ী একমাত্র নারী সংসদ সদস্য তিনি।
খাদিজাতুল আনোয়ার ফটিকছড়ি আসনে নির্বাচিত হওয়ার আগে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। কিন্তু ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ ছিল অভিভাবকশূন্য। টানা দুবার নৌকা বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগের কেউ সংসদ সদস্য ছিলেন না। উল্টো স্থানীয় সংসদ সদস্য নবিজুল বশরের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
২০১৮ সালের স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনাস্থাও প্রকাশ করে। পরে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের হস্তক্ষেপে এর সুরাহা হয়। এরপরও দূরত্ব কমেনি। হোসাইন মুহাম্মদ তৈয়বের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ সাবেক সংসদ সদস্যের সঙ্গে থাকলেও সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন। তবে দলের এই অংশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে নৌকার প্রার্থীকে জেতাতে তিনি নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। নৌকাকে জেতানোর জন্য যা যা করার সব করেছেন।
ফটিকছড়ি থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ভোটে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি প্রয়াত রফিকুল আনোয়ার। টানা দুইবার সংসদ সদস্য হয়ে তিনি এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করেন। এমনকি ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিকূল সময়েও ফটিকছড়ি থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। এ ছাড়া দানবীর হিসেবেও এলাকায় পরিচিত ছিলেন। যার কারণে এবারের নির্বাচনে বাবার কথা স্মরণ করে দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে মানুষ খাদিজাতুলকে তুলে আনেন।
খাদিজাতুল আনোয়ার জয়ী হওয়ার প্রসঙ্গে তাঁর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ের সবার দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল নৌকা প্রতীকে দলের কোনো নেতা যাতে সংসদ সদস্য প্রার্থী হন। এবার পেয়ে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত ছিলেন, যার ফলে যে যাঁর অবস্থান থেকে কাজ করেছেন। ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ এত দিন পর একজন অভিভাবক পেলেন।’
নির্বাচনে কে বিরোধিতা করেছে, কে করেনি সেটি না দেখে দীর্ঘদিন পিছিয়ে থাকা ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগকে খাদিজাতুলের নেতৃত্বে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে জানান নাজিম উদ্দিন মুহুরী।