চট্টগ্রাম কলেজে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আজ বেলা সাড়ে তিনটায় কলেজ প্রাঙ্গণে
চট্টগ্রাম কলেজে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আজ বেলা সাড়ে তিনটায়  কলেজ প্রাঙ্গণে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ চান শিক্ষার্থীরা

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ঘোষণা, হল সংস্কার, নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থীরা। আজ শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে কলেজ প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে এসব দাবি তুলে ধরেন তাঁরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম কলেজের সমন্বয়ক ইবনে হোসাইন। তিনি বলেন, ‘শহীদদের রক্তভেজা এই বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের অধিকার সুনিশ্চিত হবে। কোনো বৈষম্য থাকবে না। আমরা একটি নিরাপদ, নিরপেক্ষ ও রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে—এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’

ইবনে হোসাইন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘সম্মিলিতভাবে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সাম্প্রতিক কার্যক্রম আমাদের অধিকার ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলছে, যা আমরা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করি।’

৫ আগস্ট চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে চিকা মারার প্রসঙ্গ টেনে ইবনে হোসাইন বলেন, ‘এই ঘটনা ক্যাম্পাসে রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার নিয়মের সরাসরি লঙ্ঘন। পরে তাঁরা এসব চিকা মুছে দিয়ে গ্রাফিতি আঁকার ব্যবস্থা করেছেন। এর পর থেকে এই পর্যন্ত বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নামে-বেনামে সক্রিয় কার্যক্রম চালাতে চেষ্টা করছে, যা তাঁদের জন্য আশঙ্কার বিষয়।

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের পাঁচ নেতা-কর্মীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। ছাত্রদলের অভিযোগ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা কোনো কারণ ছাড়াই হামলা চালিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, একটি ছাত্রসংগঠনের কয়েকজন নেতা-কর্মী অধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর ক্যাম্পাসের বাইরে সমস্যা হয়েছে বলে তাঁরা শুনেছেন। এভাবে বারবার ছাত্ররাজনীতি চালু করার চেষ্টা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার।

ক্ষত এখনো শুকায়নি

সংবাদ সম্মেলনে ইবনে হোসাইন বলেন, ‘চট্টগ্রাম কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির নোংরা বাস্তবতার বিষাক্ত ছোবল বারবার প্রত্যক্ষ করেছেন। এই বিষাক্ত রাজনীতির কারণে অনেক সহপাঠী তাঁদের জীবনের মূল্যবান সময় হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের ক্যাম্পাসকে। কেউ জীবন পর্যন্ত হারিয়েছেন।

ইবনে হোসাইন আরও বলেন, ‘যখন ছাত্রলীগের বর্বর আক্রমণের সেই ভয়াল দিনগুলো স্মরণ করি, তখন আমাদের বুক ব্যথায় ফেটে যায়। সেই নির্মম আঘাতের দগদগে ক্ষত এখনো শুকায়নি। আমাদের ভাইদের রক্তমাখা মাটিতে আমাদের চোখের জল এখনো গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই ক্ষত, সেই যন্ত্রণা কেউ বুঝতে চায় না। কেউ আমাদের ন্যায়বিচার দিতে চায় না। আমাদের সহপাঠীদের, আমাদের বন্ধুদের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ন্যায়বিচারের দাবিতে জ্বলছে। এই নোংরা রাজনীতি আমাদের শিক্ষা, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের স্বপ্নকে গিলে ফেলেছে।’

ছাত্র সংসদের বিষয়ে উল্লেখ করে ইবনে হোসাইন বলেন, জুলাই বিপ্লবের মূল হাতিয়ার ৯ দফার অন্যতম দাবি ছিল ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা এবং এই নীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে অপরিহার্য। ফলে ছাত্রদের অধিকার সংরক্ষণে ছাত্র সংসদভিত্তিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি। ছাত্র সংসদ হবে একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দলীয় রাজনীতির প্রভাব ছাড়াই শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকার ও সমস্যার সমাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারবে।

পাঁচ দাবি

১. চট্টগ্রাম কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা। ২. আন্দোলনে নিহত ওয়াসিম আকরামের নামে কলেজের কোনো বিশেষ স্থাপনার নামকরণ এবং তাঁর পরিবারের পুনর্বাসনে কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা রাখা। ৩. দ্রুত হল সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা। ৪. যারা পতিত স্বৈরাচারের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং জুলাই বিপ্লবে নির্যাতনকারী হিসেবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা এবং শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ৫. নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। জুলাই বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার কলেজ প্রশাসন থেকে বহন করা।

ছাত্রশিবিরের প্রতিবাদ

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কলেজ প্রাঙ্গণে পাঁচ নেতা-কর্মীকে মারধর করার অভিযোগ করে ছাত্রদল। কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাফরাশ নুরী সিজ্জি অভিযোগ করে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম কলেজে গিয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রদলের কর্মী আশরাফ উদ্দিন। কলেজ প্রাঙ্গণে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা এসে আশরাফের গতি রোধ করেন। মারধর করে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন। পরে বেলা তিনটায় মারধরের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ নিয়ে ছাত্রদলের ১০ নেতা-কর্মী কলেজের অধ্যক্ষের কাছে যান। অভিযোগ দিয়ে বের হওয়ার সময় ইসলামী ছাত্রশিবির নেতা-কর্মীরা গিয়ে হামলা চালান।

তবে ছাত্রদলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম নগরের (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক তানজীর হোসেন গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘বহিরাগত কিছু ব্যক্তি কলেজের বাইরে ঝামেলা করেছিল বলে খবর পেয়েছেন তিনি। হামলার সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’

এদিকে ছাত্রদলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম নগরের (উত্তর) সভাপতি ফখরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক তানজীর হোসাইন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

তবে কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাফরাশ নুরী সিজ্জি আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ওপর ছাত্রশিবিরের হামলায় ঘটনায় মামলা করব আমরা। এটি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’